রাতের হাইওয়েতে গাড়ি চালানোর মত পুরনো ভীতিকর পরিস্থিতিগুলো প্রতিনিয়ত দুঃসংবাদের পাল্লাকে ভারী করছে। রাতের অন্ধকারে নির্জন হাইওয়েতে গাড়ি ডাকাতির ঘটনাগুলো নতুন নয়। নানা ভণিতায় গাড়ি থামিয়ে আরোহীদের সর্বস্ব কেড়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে দীর্ঘ দূরত্বের এই যাত্রাগুলো ক্রমশ এগিয়ে যায় প্রাণহানির দিকে। অভিজ্ঞ ও দক্ষ গাড়ি চালকেরাও এই নির্মম শিকার থেকে রেহাই পান না। তাই যে কোনো দূরত্ব অতিক্রমের ক্ষেত্রে সন্ধ্যার পর অথবা গভীর রাতে হাইওয়েতে গাড়ি চালানোর সময় সতর্কতার বিষয়টিতে গুরুত্বারোপ করা আবশ্যক। এ অবস্থায় করণীয়সমূহ নিয়েই আজকের এই সতর্কতামূলক ফিচার।
রাতে হাইওয়েতে গাড়ি চালানোর সময় করণীয়সমূহ
গাড়ি চালানোর সময় বিভ্রান্ত না হওয়া
আলোর স্বল্পতার কারণে রাতে গাড়ি চালানোর সময় বিভ্রান্ত হয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক। এগুলো থেকে যতটুকু সম্ভব নিজেকে দূরে রাখা উচিত। তবে কিছু ঐচ্ছিক বিষয় আছে, যেগুলো একজন চালক হরহামেশাই করে থাকেন। যেমন- গাড়ি চালানোর সময় ফোনে কথা বলা, ম্যাসেজ পাঠানো, রেডিও চ্যানেল ঘুরানো, এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও ব্যবহার করতে দেখা যায়। দীর্ঘ দূরত্বে ভ্রমণের সময় গাড়ি দ্রুত গতিতে থাকার সময় ফেসবুকে ছবি পোস্ট, চ্যাট করা রীতিমত ভীতিজনক। এই অবস্থায় অকস্মাৎ ঘটে যেতে পারে ডাকাতিগুলো। ইতোমধ্যে অসাবধান থাকা গাড়ি চালকের তখন সম্বিত ফিরে পাওয়া নিয়েই বিপত্তিতে পড়তে হয়।
বর্তমানে সামনের রাস্তা থেকে চোখ ফিরিয়ে অনেককেই গুগল ম্যাপ চালাতে দেখা যায়। এখানে ছোট্ট একটা গুরুত্ব নিয়ে ভাবতে গিয়ে ঝুঁকিতে পড়ে যায় পুরো জীবনটাই। কারণ গাড়ি চালানোর সময় চোখ সব সময় সামনের রাস্তার দিকে রাখা জরুরি। এসময় এমনকি কোনো কিছু খাওয়া বা পান করাও উচিত নয়।
হাইওয়েতে গাড়ি ডাকাতির জন্য গাড়ির দিকে কোনো কিছু ছুঁড়ে মেরে গাড়ি থামানোর পাঁয়তারা করা হয়ে থাকে। তাই উইন্ডশিল্ডে কিছু পড়লেই রেইন ওয়াইপার চালিয়ে দেওয়া যাবে না। এমনকি গ্লাস ভেঙে দিলেও না দাড়িয়ে দ্রুত গাড়ি চালিয়ে ঘটনাস্থল থেকে সরে পড়তে হবে।
দীর্ঘ দূরত্বের জন্য গাড়িতে যথেষ্ট জ্বালানি রাখা
অনেক সময় ধরে গাড়ি চালানোর জন্য পর্যাপ্ত জ্বালানি থাকা আবশ্যক। হাইওয়েতে নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর গ্যাস স্টেশন থাকলেও বেশি পরিমাণে গ্যাস ও তেলে পরিপূর্ণ করে গাড়ি নিয়ে রওনা হওয়া উচিত। অর্থাৎ ভ্রমণের পূর্বে গাড়িতে বসে স্টার্ট দেওয়ার আগে জ্বালানির পরিমাণটা ভালো করে চেক করে নিতে হবে। তাছাড়া অনেক দূরের পথে অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক কিছুই ঘটতে পারে। তাই গাড়ির জ্বালানির মাত্রা এক তৃতীয়াংশের নীচে চলে যাওয়া মাত্রই গ্যাস স্টেশনের খোঁজ করা উচিত।
গাড়ি চালানোর সময় সব দরজা-জানালা লক রাখা
এই কাজটি গাড়ির বাইরে থেকে আগত আক্রমণ থেকে প্রাথমিকভাবে রক্ষা করতে পারে। আকস্মিকতা কাটিয়ে কিছু সময় চিন্তা-ভাবনার জন্যও যথেষ্ট সময় পাওয়া যাবে দরজা-জানালা সব লক করা থাকলে। কিন্তু তা না হলে প্রথমেই আত্মরক্ষার সকল পন্থার অবসান ঘটবে। অবশ্য যে কোনো সশস্ত্র আক্রমণে আত্মসমর্পণই শ্রেয়।
কোনো রকম তর্ক, মারামারি ছাড়াই দাবি করা মূল্যবান জিনিসপত্র দেওয়া হলে গুরুতর আহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। দুর্বৃত্তরা গাড়িতে ঢুকতে না পারলে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তাদের নির্দেশিত পথে গাড়ি চালাতে বাধ্য করতে পারবে না। পাশাপাশি দ্রুত পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ারও সুযোগ থাকে। অতঃপর জনবহুল জায়গায় এসে স্থানীয়দের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। প্রয়োজনে পুলিশকে ফোন করা যেতে পারে।
মূল্যবান জিনিসপত্র দৃষ্টির বাইরে রাখা
দীর্ঘ ভ্রমণের ক্ষেত্রে প্রায়ই গাড়িতে বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় জিনিস বহন করা হয়ে থাকে। টাকা, ডেবিট অথবা ক্রেডিট কার্ড, গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ইত্যাদি জিনিসপত্র চোখের আড়ালে রাখা উচিত। বিশেষ করে ড্রাইভিং ও প্যাসেঞ্জার সিট এবং গাড়ির ড্যাশবোর্ড এড়িয়ে চলা দরকার। এক জেলা থেকে আরেক জেলায় যাবার সময় রওনা হওয়ার মুহুর্তেই মূল্যবান জিনিসগুলোর একটা ব্যবস্থা করে নেওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে অর্থ খরচের জন্য যতটা সম্ভব ডিজিটাল মাধ্যমগুলো ব্যবহারের চেষ্টা করতে হবে।
অন্যকে সাহায্যের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা
গভীর রাতে ভ্রমণের সময় রাস্তার এক পাশে কোনো গাড়ি পার্ক করা বা কাউকে হাত ইশারায় সাহায্য প্রার্থনা করতে দেখা যেতে পারে। এই ঘটনাগুলো যে কাউকে গাড়ি থামাতে বাধ্য করবে। তাছাড়া এমতাবস্থায় সে যদি সত্যিই বিপদে পড়ে থাকে তাহলে তাকে সাহায্য করা কর্তব্য। কিন্তু এই ভণিতায় অনেকে গাড়ি ডাকাতিও করে থাকে। শুধু তাই নয়; ব্যাপারটি সাহায্যপ্রার্থী ও গাড়ি চালক দুজনের ক্ষেত্রেই ঘটতে পারে।
অসহায় হয়ে লিফ্ট চাওয়া কোনো ব্যক্তির জন্য সাহায্যার্থে এগিয়ে আসা কোনো গাড়ি যেমন বিপজ্জনক, ঠিক তেমনি একজন গাড়ি চালকের জন্যও সেই লিফ্ট চাওয়া ব্যক্তিটি বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এই বিষয়ে কেউই নিশ্চয়তা দিতে পারেন না। এক্ষেত্রে যদি সাহায্য করতে হয় তবে গাড়ি না থামিয়ে জনবহুল জায়গায় গিয়ে স্থানীয়দের ব্যাপারটি জানানো যেতে পারে। তাছাড়া পুলিশেও কল করে সাহায্যের জন্য আবেদন করা যেতে পারে। রাস্তার মাঝে কাউকে অদ্ভুত ভঙ্গিমায় শুয়ে থাকতে দেখলেও মারা গেছে ভেবে তার পাশে গাড়ি না থামানোই উত্তম।
ঝুঁকিপূর্ণ স্থান সম্পর্কে আগে থেকেই সতর্ক থাকা
তেল বা গ্যাস নেবার সময় একটু ভিড় থাকা স্টেশনগুলো নির্বাচন করতে হবে। দেরি হলেও যতটা সম্ভব একাকী এবং বিচ্ছিন্ন পথগুলো এড়িয়ে যাওয়া উচিত। অনেক সময় কম সময়ে ভ্রমণের জন্য অনেকে বিকল্প শর্টকাট পথ বাছাই করেন। এই ধরনের পথ ডাকাতরাও টার্গেট করে তাদের স্বার্থসিদ্ধি করার জন্য।
কারণ এই পথগুলোতে মানুষের আনাগোনা অপেক্ষাকৃত কম থাকে। এই পথগুলো বাছাই করা মানেই নিজেকে ভয়াবহ বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া, কেননা এখানে চিৎকার করলেও আশেপাশে অনেক দূর পর্যন্ত সাহায্যের জন্য কাউকে পাওয়া যাবে না। সবচেয়ে নিরাপদ হলো দীর্ঘ সময় ধরে গাড়ি চালনার ক্ষেত্রে সঙ্গে কাউকে নিয়ে নেওয়া। একসাথে গ্রুপে ভ্রমণ করলে বিপদের আশঙ্কা অনেকাংশে কমে যায়।
অপেক্ষাকৃত বেশি আলোকিত স্থানে থাকা
হাইওয়েতে যানজট ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের যানবাহনগুলোকে অনেকটা এক লাইনে থেকে চলতে দেখা যায়। এ সময় পেছনের গাড়ির হেডলাইটের আলো সামনের গাড়ির ওপর পড়ে। বড় বাস-ট্রাক হলে এই আলোর পরিমাণটা আরো বেড়ে যায়। এভাবে অন্যান্য গাড়ির ভিড়ের মধ্যে চলমান থেকে গাড়ি চালানো যেতে পারে।
এছাড়া দু’পাশ দিয়ে সারিবদ্ধ ল্যাম্প পোস্টগুলোও বেশ আলো দেয়। কিন্তু সব জায়গায় এই সুবিধা পাওয়া যায় না। আর স্বাভাবিক ভাবেই অনেক ল্যাম্প পোস্ট নষ্ট হয়ে আলো ছাড়াই দাঁড়িয়ে থাকে। তাই গাড়ির ভেতর তীক্ষ্ণ আলোর টর্চ লাইট রাখা যেতে পারে। রাতের হাইওয়েতে গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে রাখা ভালো। কিন্তু অনেক সময় ধরে জ্বলে থাকার কারণে হেডলাইট নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তখন যে কোনো সম্ভাব্য আক্রমণের ক্ষেত্রে সেই টর্চ লাইট জ্বালিয়ে আশেপাশের গাড়ি বা মানুষদের সংকেত দেওয়া যাবে।
ভিড়ের মধ্যে থাকা
কয়েকটি গাড়ির সঙ্গে এক লাইনে থাকলে আলোর পাশাপাশি সঙ্গও পাওয়া যাবে। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই গাড়ির হাইওয়ে গতি ঠিক রাখতে হবে। গতি কম রাখলে অসাবধানতাবশত পেছনের গাড়িটি ধাক্কা মেরে দিতে পারে। আবার খুব বেশি গতি সামনের গাড়ির সাথে ধাক্কা লাগিয়ে দিতে পারে। হঠাৎ যদি মনে হয় কোনো বাইক বা গাড়ি অনুসরণ করছে, তখন তাদের থেকে দূরে থাকতে হবে। প্রয়োজনে একটি বড় হোটেল বা জনবহুল গ্যাস স্টেশনে আশ্রয় নেওয়া যেতে পারে।
গাড়িতে হুইসেল রাখা
দীর্ঘ ভ্রমণে মাঝ রাস্তায় গাড়ির হর্ন নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তখন দূরের বা আশেপাশের মানুষ ও গাড়িগুলোকে সংকেত দেওয়ার জন্য এই হুইসেল কাজে লাগানো যাবে।
গাড়িতে অ্যারোসল বা ইন্সেক্ট কিলার রাখা
আক্রমণকারীকে শারীরিকভাবে ক্ষতি করার জন্য কাছাকাছি আসার পথে যতগুলো বাধা তৈরি করা যায় ততই ভালো। এর জন্য গাড়ির দরজা-জানালা লক রাখা, গাড়িতে টর্চ লাইট ও হুইসেল রাখার পাশাপাশি ছোট অ্যারোসল কিংবা ইন্সেক্ট কিলার রাখা যেতে পারে। সব বাধাগুলো উতরে একদম কাছে চলে এলে আক্রমণকারীর চোখে স্প্রে করে দেওয়া যেতে পারে। চরম মুহুর্তে এগুলোই বড় হাতিয়ার হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাছাড়া এতে বেশ কিছুটা সময়ও পাওয়া যাবে, যে সময়ে আশেপাশের সাহায্যকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ির কাছে দ্রুত এগিয়ে আসতে পারবে।
পরিশিষ্ট
রাতে হাইওয়েতে গাড়ির চালানোর ক্ষেত্রে সাবধানতার অর্থ হলো যে কোনো পরিস্থিতির জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখা। দুর্ঘটনার আকস্মিকতায় অনেকেরই সম্বিত ফিরে পেতে বা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হয়। এই সাবধানতাগুলো যাত্রা পথে শরীর ও মন দুটোকে সদা সতর্ক থাকার দিকে ধাবিত করবে। সব ধরনের সতর্কতা নেওয়ার পরেও অনর্থ ঘটার আশঙ্কা থেকেই যায়। আর খুব অভিজ্ঞ লোকরাও এই আশঙ্কার বাইরে নন। এক্ষেত্রে সব রকম প্রস্তুতির নেওয়ার পাশাপাশি মহান সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা করা উচিত। আশা করা যায়, কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিত সৃষ্টি হওয়া ছাড়াই দীর্ঘ যাত্রা শুভ হবে।