হার্দিক পান্ডিয়ার বদলে যাওয়ার গল্প

খেলা

মে ৩১, ২০২২ ১:৪১ অপরাহ্ণ

ইনিই কি তিনি! শরীরজোড়া ট্যাটু। দু’কানে হিরের দুল ঝকঝক করছে। গলায় গাম্ভীর্য। মাঝে মধ্যে হাসি। ইনিই তো হার্দিক পান্ডিয়া। তবে ইনি হার্দিক পান্ডিয়া নন! ইনি হার্দিক পান্ডিয়া-২। যার আবির্ভাব হয়েছে জীবনের রগড়ানি খেয়ে। করণ জোহরের বিতর্কিত টক শো-র আসর যাকে ‘জাতীয় ভিলেন’ বানিয়ে দিয়েছিল, ২০২২ সালে তার আবির্ভাব হল অন্য অবতারে।

হার্দিক পান্ডিয়া-২ অনেক শান্ত। অনেক পরিণত। যিনি হারলে প্রকাশ্যে ভেঙে পড়েন না। জিতলে প্রকাশ্যে উচ্ছ্বসিতও হন না। আবির্ভাবেই অধিনায়ক হিসেবে আইপিএল ট্রফি জিতেও না। বরং ট্রফি নিয়ে এসে সতীর্থদের হাতে দিয়ে নিজে সরে যান ফ্রেমের এক কোণায়। এই হার্দিক টিম জেতার পর স্লিভলেস জার্সিতে মাঠে নামেন বটে। কিন্তু পুরস্কার নিতে যাওয়ার আগে পরে নেন টিম জার্সি।

হার্দিক পান্ডিয়া-২’কে অনেক বেশি আশ্বস্ত দেখায় স্ত্রী নাতাশার আলিঙ্গনে। আহমেদাবাদের দানবীয় স্টেডিয়ামের গ্যালারি থেকে যিনি মাঠে নেমে এসেছিলেন গুজরাট জয়ের রান তোলার পরেই। ডাগ আউটে যেখানে একলা একটা চেয়ারে বসে ছিলেন হার্দিক।

জয়ের ছয় মারার পর হেলমেট খুলে ২২ গজের উপর যখন শুভমন গিল সিংহগর্জন করছেন, হাত থেকে ব্যাট ফেলে দিয়ে জয়ের স্ট্রোক-মারা সতীর্থের কোলে ঝাঁপিয়ে উঠে পড়ছেন নন স্ট্রাইকার ডেভিড মিলার, তখন তাদের অধিনায়কের মুখে মৃদু হাসি। মৃদুই। যে হাসি চওড়া হল নাতাশা মাঠে নেমে এসে সফল স্বামীকে জড়িয়ে ধরতে।

স্ত্রী-কে আলিঙ্গনাবদ্ধ রেখেই হার্দিক পান্ডিয়া-২ এগোলেন মাঠের ভিতরে। একে একে হাত মেলালেন প্রতিপক্ষের ক্রিকেটারদের সঙ্গে। হার্দিক পান্ডিয়া বলিউড পরিচালকের টক শো-তে গিয়ে রোয়াব দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘জীবনে প্রথম বার যৌনসঙ্গম করে এসে বাবা-মা’কে বলেছিলাম, করকে আয়া হুঁ!’ করণ হ্যা-হ্যা করে হেসেছিলেন। গোটা দেশ ক্রোধে, বিরক্তিতে, ঘৃণায় ফুঁসছিল। প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছিলেন হার্দিক পান্ডিয়া। কিন্তু শাপমোচন হয়েছিল কি?

হার্দিক পান্ডিয়া-২ অনেক পারিবারিক। স্ত্রী এবং সন্তান নিয়ে থাকতে-চাওয়া এক সফল এবং নোঙর-ফেলা পেশাদার। যে সাফল্যের প্রকাশভঙ্গিতে কোনো ঔদ্ধত্য নেই। তবে আত্মবিশ্বাস আছে। হার্দিক পান্ডিয়া-২ নিজের চেয়ে দলের কথা অনেক বেশি বলেন। সতীর্থদের আনন্দ করতে দিয়ে নিজে লাইনের এক প্রান্তে দাঁড়ান। ঠিক তার পূর্বসূরি মহেন্দ্র সিং ধোনির মতো।

হার্দিক পান্ডিয়া-২ খোলাখুলিই বলেন, মহেন্দ্র সিংহ ধোনির থেকে অনেক কিছু শিখেছেন। ধোনির নেতৃত্বেই আন্তর্জাতিক মঞ্চে অভিষেক ঘটেছিল হার্দিকের। ফাইনালে উঠে হার্দিক বলেছিলেন, মাহিভাই আমার জীবনে খুব বড় ভূমিকা নিয়েছে। ও আমার দাদা, বন্ধু এবং পরিবারের অংশ। আমি ওর থেকে অনেক কিছু শিখেছি।

তবে কি ২০২২ সালের আইপিএল নতুন ধোনির জন্ম দিল?

কঠিন পরিস্থিতির সামনে হার্দিক পান্ডিয়া-২ কখনও চিন্তিত হন না। অন্তত প্রকাশ্যে। ঠান্ডা মাথায় স্কোর বোর্ড সচল রাখেন। খুনে মেজাজে ব্যাট করতে করতে উইকেট ছুড়ে দিয়ে আসেন না। ইডেনে ৪০ রানের ইনিংসে পাঁচটি চার মেরেছিলেন। ছক্কা? একটিও নয়। দলের প্রয়োজন ছিল তার উইকেটে থাকা।

আইপিএলে গ্রুপ পর্বে ১৪টি ম্যাচের মধ্যে ১০টিই জিতেছিল গুজরাট। কিন্তু মৌসুমের শুরুতে হার্দিককে অধিনায়ক করার পর অনেকেই অবাক হয়েছিলেন। তবে আইপিএল বরাবরই চমক দেয়। আইপিএলই চিনিয়েছিল অলরাউন্ডার হার্দিককে। মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের হয়ে পারফরম্যান্সই হার্দিকের সামনে জাতীয় দলের দরজা খুলে দিয়েছিল। সেই আইপিএলই এবার চেনাল অধিনায়ক হার্দিককে। হার্দিক পান্ডিয়া-২।

হার্দিক পান্ডিয়া-২ বলেন, জীবনের সবকিছুতে একটা ভারসাম্য আনার চেষ্টা করেছি। অধিনায়ক হওয়ার আগেও চেষ্টা করেছি যেকোনো পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রাখতে। তাতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হয়। দ্রুত সব কিছুর মধ্যে ঢুকে যাওয়ার থেকে ১০ সেকেন্ড সময় নিয়ে ভেবে কোনো কিছু করাটা খুব জরুরি।

হার্দিক পান্ডিয়া-২ অধিনায়কত্ব শিখেছেন ধোনি, বিরাট কোহলি এবং রোহিত শর্মার থেকে। যিনি বলছেন, বিরাটের থেকে আগ্রাসন শিখতে চাই। যে আবেগ, শক্তি ও মাঠে দেখায় সেটা অভাবনীয়। মাহিভাই শান্ত। যে কোনো পরিস্থিতিতে এক ভাবে থাকতে পারে। রোহিতের থেকে শিখতে চাই, ও যেভাবে ক্রিকেটারদের উপর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার ছেড়ে দেয়, সেটা।

হার্দিক পান্ডিয়া-২’এর তার নেতৃত্বে-খেলা ডেভিড মিলার বলেন, গুজরাট দলে আমরা সবাই জানি কার কী দায়িত্ব। সে জন্যই নিজেদের সেরা খেলাটা খেলতে পারি।

বিতর্কিত টক শো অতীত। আইপিএল জয়ের মঞ্চেই অতীতের অন্ধকার সরিয়ে সম্ভবত শাপমুক্তি হল হার্দিক পান্ডিয়ার। রোহিত শর্মার উত্তরসূরি হিসেবে লোকেশ রাহুল, শ্রেয়স আয়ারদের সঙ্গে আরও একটা নাম ভাসিয়ে দিয়ে গেল রবিবারের আহমেদাবাদ— হার্দিক পান্ডিয়া-২।

সূত্র: আনন্দবাজার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *