সংকট কি শুধুই বৈশ্বিক কারণে?

অর্থনীতি স্পেশাল

জুলাই ২৪, ২০২২ ৯:৩৪ পূর্বাহ্ণ

কিছুদিন আগেও মনে করা হতো, বাংলাদেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভাসা একটি ব-দ্বীপ। সংকটকালে দেখছি, এর অনেকটাই ফাঁকা বুলি। মনে হচ্ছে, বিভিন্ন সময়ে নেওয়া অনেক সিদ্ধান্ত শক্ত ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। এদিকে সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী বছরের শেষদিকে সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা। এ কারণে সরকারি নীতিনির্ধারকদের কথা ও কাজে এক ধরনের সমন্বয়হীনতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এটা মানতেই হবে, আমরা এখন একটি বৈশ্বিক সংকটের মুখোমুখি। আমাদের সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অনুষ্ঠিত জি-২০ভুক্ত দেশগুলোর অর্থমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নরদের এক সভায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা ঋণ নেওয়া দেশগুলোকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘বিশ্ব অর্থনীতির ভবিষ্যৎ যদি বালির আকাশের মতো উজ্জ্বল হতো, তাহলে খুবই খুশি হতাম; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাস্তবতা তেমন নয়। বিশ্ব অর্থনীতির পূর্বাভাস অনেকটাই ফিকে হয়ে আসছে। অনিশ্চয়তা তুঙ্গে।’ এমন কঠিন অর্থনৈতিক বাস্তবতার ভেতরেও আমাদের রাজনীতিকরা পরস্পর পুরোনো খুনসুটির বলয়েই আবর্তিত হচ্ছেন। তাই বিষয়গুলো নিয়ে একটি গোছালো আলোচনাও প্রায় অসাধ্য হয়ে পড়েছে। তারপরও সাধ্যের ভেতরে থেকে দু-চার কথা বলার প্রয়োজন বোধ করছি।

১.

বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর আবদুর রউফ দায়িত্ব নেওয়ার পাঁচ দিনের মাথায় খেলাপি ঋণ ঠেকাতে বড় ধরনের ছাড় দিয়েছেন। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ফলাফল নিয়ে সংশয় আছে। আগে জেনে নেওয়া যাক আমাদের খেলাপি ঋণের সর্বশেষ চিত্রটি কী। করোনাকালে সাবেক গভর্নর ফজলে কবির ঋণ পরিশোধে যে ছাড় দিয়েছিলেন, তা এখন আর নেই। তাই নতুন করে আবার ঋণখেলাপির তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। করোনার বিপর্যয় ঠেকাতে এবং অর্থনীতির গতি ধরে রাখতে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া হয়েছিল। সেগুলোরও একটি বড় অংশ অনাদায়ি রয়ে গেছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা। ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকায়। অর্থাৎ মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। এ ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের ডিসেম্বরে বাড়তি খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়াতে পারে। অত্যন্ত উদ্বেগের একটি চিত্র। সেই চিত্র যাতে দেখতে না হয়, সেজন্যই বাংলাদেশ ব্যাংক এতটা ছাড়ের ব্যবস্থা করেছে। আগে যে কোনো পরিমাণ মেয়াদি খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে হলে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ এককালীন অর্থ জমা দিতে হতো। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী আড়াই থেকে ৬ শতাংশ জমা দিলেই চলবে। আগে চলমান ও তলবি খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে ৫ থেকে ১৫ শতাংশ অর্থ জমা দিতে হতো; নতুন নিয়ম অনুযায়ী মাত্র আড়াই থেকে ৫ শতাংশ অর্থ জমা দিলে তা নিয়মিত হয়ে যাবে। পরিশোধের সময়েও সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। আগের নিয়মে খেলাপি মেয়াদি ঋণ নিয়মিত হওয়ার পর পরিশোধের সময়সীমা ছিল ৯ থেকে ২৪ মাস বা ২ বছর। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, ১০০ কোটি টাকার কম ঋণে পরিশোধের সময় ৬ বছর, ৫০০ কোটি টাকার কম ঋণে ৭ বছর এবং ৫০০ কোটি টাকার ওপরে পরিশোধের সময় পাওয়া যাবে ৮ বছর। চলমান ও তলবি ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। আগে চলমান ও তলবি ঋণ নিয়মিত হলে পরিশোধের সময় ছিল ৬ থেকে ১৮ মাস। নতুন নীতিমালায় এ সময় ৫০ কোটি টাকার কম হলে ৫ বছর, ৩০০ কোটি টাকার কম হলে ৬ বছর, আর ৩০০ কোটি টাকার বেশি হলে ৭ বছর। পরিশোধের সুবিধা ছাড়াও খেলাপিদের আরও সুযোগ দেওয়া হয়েছে। যেমন-যেসব খেলাপি তাদের ঋণ নিয়মিত করবে, তারা পুনরায় ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারবে। এর জন্য সাধারণ গ্রাহককে বকেয়া ঋণের ৩ শতাংশ পরিশোধ করতে হবে। রপ্তানিকারকদের বেলায় বকেয়া ঋণের মাত্র ২ শতাংশ জমা দিলেই চলবে। আগে নতুন ঋণ নিতে হলে সাধারণ গ্রাহকদের বকেয়ার ১৫ শতাংশ এবং রপ্তানিকারকদের বকেয়ার সাড়ে ৭ শতাংশ টাকা জমা দিতে হতো।

শিথিলতার সবটুকুনই করা হয়েছে খেলাপি ঋণের প্রবাহের গতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য। কিন্তু খেলাপি হওয়ার কারণগুলো সুনির্দিষ্ট না করে এবং তা প্রতিকারের ব্যবস্থা না করে গণহারে ছাড় দেওয়াটা প্রশ্নসাপেক্ষ। এটি বিপরীত ফল বয়ে আনতে পারে। এ প্রসঙ্গে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমানে অনেক দেশ সমস্যায় পড়ে গেছে। শ্রীলংকার পরিস্থিতি আমরা দেখতে পাচ্ছি। এজন্য আগ বাড়িয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এমন সুবিধা দিয়েছে। যারা ভালো গ্রাহক হিসাবে পরিচিত, ক্ষুদ্র ও মাঝারি গ্রাহক-তাদের এসব সুবিধা দিলে ভালো হতো। গণহারে এমন সুবিধা কখনোই ভালো ফল দেয় না। খেলাপি ঋণ আদায়ে শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। ঋণ নীতিমালায় এমন ছাড়কে আইএমএফ কীভাবে নেবে, এটিও দেখার বিষয়। কিন্তু আমাদের দেশে ঋণ খেলাপের যে অনাকাঙ্ক্ষিত সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তাতে করে নতুন নীতিমালা আরও নতুন নতুন খেলাপি তৈরির সুযোগ করে দেবে কিনা সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

২.

বৈদেশিক বাণিজ্য নিয়ে আমরা দুরবস্থার মধ্যে আছি। বৈশ্বিক সংকট তো আছেই, আমাদের ভুল নীতিমালার কারণে ভোগান্তির মাত্রা দিনকে দিন বাড়ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসাবে ডলারের দাম সমন্বয় করতে পারছি না। গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি ডলারের দাম নির্ধারণ করেছিল ৯৩ টাকা ৯৫ পয়সা। কিন্তু ব্যাংকগুলো প্রতি ডলার বিক্রি করেছে ১০০ টাকায়। খোলাবাজারে ১০৩ টাকায় বিক্রি হলেও চাহিদা অনুযায়ী ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। ডলারের বাজারকে স্থিতিশীল রাখতে গত ১ বছরে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ৮ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বিক্রি করেছে। তারপরও সমস্যা থেকেই গেছে। এর সমাধানের সময় নির্দিষ্ট করা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের ভাষ্য হলো, ‘দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যে যে মাত্রার সামঞ্জস্যহীনতা তৈরি হয়েছে, সেটি সহসা কাটিয়ে ওঠা কঠিন। বহু আগে থেকেই অর্থনীতিবিদরা আমদানির ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়ে আসছিল। কিন্তু সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক ‘দেখব, দেখছি’ বলে সময়ক্ষেপণ করেছে। এ কারণে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে।’ গত অর্থবছরে আমদানিতে প্রায় ৯০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হয়েছে। প্রকৃতই ব্যয় করা ডলারের সমপরিমাণ পণ্য দেশে আমদানি হয়েছে কিনা, তা এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। কেননা দেশের শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান থেকে শুরু করে অর্থনীতির কোনো সূচকেই এ বিপুল পরিমাণ আমদানির কোনো ধরনের প্রতিফলন নেই। আমদানির নামে দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়ে গেল কিনা, তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। ২০১৩-১৪ সালের দিকে বেসরকারি খাতের জন্য বিদেশি ঋণ নেওয়ার পথ উন্মুক্ত করা হয়েছিল। তখন এর ফলাফল পর্যালোচনা করা হয়নি। এখন বেসরকারি খাতেও বিদেশি ঋণের পরিমাণ ২৫ বিলিয়ন ডলার হয়ে গেছে। রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) নামে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে যে ঋণ দেওয়া হয়েছে, সেটিও আদায় হচ্ছে না। সব মিলে বৈদেশিক বাণিজ্যে সামঞ্জস্য ফিরিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই, যদিও এ মুহূর্তে তা সহজ নয়। এ সংকট মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক, রাজস্ব বোর্ডসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে এক হয়ে কাজ করতে হবে।

৩.

আমরা এখন বিদ্যুৎ ভোগান্তির মধ্য দিয়ে চলেছি। পৃথিবীময় যে জ্বালানি সংকট তৈরি হয়েছে, তা বিশ্বের অনেক দেশকেই আক্রান্ত করেছে। এশিয়া ও ইউরোপের অনেক শক্তিশালী অর্থনীতির দেশও তাদের জনগণকে বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো দেশে চলছে বিদ্যুৎ-রেশনিং। আমাদের দেশেও লোডশেডিং ব্যবস্থা চলমান। এতে করে সাধারণ মানুষ ও উৎপাদকরা অসন্তুষ্ট। জনগণের অসন্তুষ্টিতে একদল সুবিধাভোগী বেজায় নাখোশ। তারা বৈশ্বিক বিরূপ অবস্থাকে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। কোনো সংকটকালে ভোগান্তি হতেই পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আজকের সংকট কি শুধুই বৈশ্বিক কারণে? আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনায় কি কোনো ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি, অদূরদর্শিতা আর রেন্ট-সিকারদের দৌরাত্ম্য নেই? নেই কি কোনো পরিকল্পনার অভাব? এ প্রশ্নগুলো এ সময়ে খুব বেশি প্রাসঙ্গিক।

গত ২০ বছরে আমরা আমাদের স্থল ও সমুদ্র অঞ্চলে কোনো ধরনের কার্যকর গ্যাস অনুসন্ধান চালাতে পারিনি। বিদ্যুৎ উৎপাদনকে পুরোমাত্রায় আমদানিকৃত জ্বালানিনির্ভর করে ফেলেছি। আমি গ্যাস উত্তোলন করে ফুরিয়ে ফেলার জন্য অনুসন্ধানের কথা বলছি না। তবে গ্যাসের পর্যাপ্ত মজুত নিশ্চিত করা গেলে বিপদের সময়টা পার করা সহজ হয়, গর্তে পড়ে যেতে হয় না। আমরা সেটা করিনি। উৎপাদন ব্যবস্থাতেও অরাজকতার সৃষ্টি করেছি। আমাদের বর্তমানে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা ২২ হাজার ৩৪৮ মেগাওয়াট। দৈনিক বিদ্যুতের চাহিদা ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। অর্থাৎ চাহিদার চেয়ে প্রায় ৭ হাজার মেগাওয়াটের অতিরিক্ত সক্ষমতা রয়েছে। এ বছর আরও তিনটি প্ল্যান্ট যুক্ত হওয়ার কথা। তাহলে সক্ষমতার পরিমাণ বাড়বে। চাহিদার চেয়ে সক্ষমতা বেশি হওয়া তো আশার কথা হওয়া উচিত ছিল; কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। এ অতিরিক্ত সক্ষমতায় বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও প্ল্যান্ট মালিকদের ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়। গত তিন বছরে সরকারকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে ৫৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১৯-২০ সালে ১৮ হাজার ১২৪ কোটি টাকা, ২০২০-২১ সালে ১৮ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা এবং সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে ব্যয় করা হয়েছে ১৬ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকা। তার মানে হলো, বিদ্যুতের কোনো ধরনের উৎপাদন ও ব্যবহার ছাড়াই এ দেশের জনগণের ৫৪ হাজার কোটি টাকা তুলে দেওয়া হয়েছে গুটিকয় প্ল্যান্ট মালিকের হতে। জনগণের সঙ্গে এমন নির্দয় আচরণ করার অধিকার কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের আছে কি? এ প্রশ্ন ওঠা অবান্তর নয়।

সরকারের উপর মহল থেকে গত ১২ বছর ধরে বলতে থাকা ‘ষড়যন্ত্র’ শব্দটি আর শোনার মতো ধৈর্য নেই আমাদের। আমরা লুটপাটের রাজনীতির অবসান চাই, জনগণের অর্থের ন্যায়সংগত হিসাব চাই, যা একটি গণতান্ত্রিক সরকার দিতে বাধ্য।

মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *