শূন্য থেকে শুরু করে বর্তমানে কোটি কোটি টাকার মালিক তারা

শূন্য থেকে শুরু করে বর্তমানে কোটি কোটি টাকার মালিক তারা

ফিচার স্পেশাল

জানুয়ারি ২২, ২০২৩ ৯:৪০ পূর্বাহ্ণ

অনেক মানুষ আছেন, যাদের উত্থান স্বপ্নের মতো মনে হয়। শূন্য থেকে শুরু করে কঠোর পরিশ্রম এবং আত্মবিশ্বাসের মাধ্যমে সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে তারা নিজেরাই কিংবদন্তি। এমনই কয়েক জন বিত্তশালী মানুষের সম্পর্কে জেনে নেয়া প্রয়োজন, যারা নিজেদের স্বপ্নপূরণ করে অন্যকে বড় স্বপ্ন দেখার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন।

এই বিত্তশালীদের মধ্যে যার নাম প্রথমেই আসে, তিনি হলেন বিশ্বের অন্যতম প্রসাধন সংস্থা ‘গুচি’-র মালিক গুচিয়ো গুচি। ১৮৮১ সালে ইতালির ফ্লোরেন্সে গুচিয়োর জন্ম। তার বাবা গ্যাব্রিয়েলো গুচি ছিলেন সান মিনিয়াতোর চামড়ার এক জন দরিদ্র কারিগর। গুচিয়োর মা এলেনা সান্তিনি ছিলেন গৃহবধূ। অত্যন্ত দারিদ্রের মধ্যে গুচিয়োর ছোটবেলা কেটেছিল।

মাত্র ১৭ বছর বয়সে দেশ ছেড়ে লন্ডনে চলে আসেন তিনি। সেখানে একটি বিলাসবহুল হোটেলে ‘লিফ্‌ট বয়’ হিসেবে চাকরি শুরু করেন। হোটেলে আসা অতিথিদের বিলাসবহুল ব্যাগ দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন গুচিয়ো। ধীরে ধীরে এ-ও বুঝতে পারেন, সস্তা ব্যাগ এবং দামী ব্যাগের গুণমানের পার্থক্য কোথায়। বহু দিনের চেষ্টার পর ১৯২১ সালে ফ্লোরেন্সে ‘গুচি’ সংস্থা তৈরি করেন গুচিয়ো। এর পর তাকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। ২০২১ সালে তার তৈরি সংস্থা ১০০ বছরে পা দিয়েছে।  বর্তমানে বিশ্বে ‘গুচি’র অসংখ্য দোকান রয়েছে। ২০২১-এ গুচি প্রায় ৯৭৩ কোটি ইউরোর ব্যবসা করেছে।

আমদাবাদের গরিব পরিবারে জন্ম নেন ভাদিলাল গান্ধী। সংসার চালাতে ১৯০৭ সালে যুবক ভাদিলাল ছোট্ট একটি দোকানে সোডা বিক্রি শুরু করেন। ধীরে ধীরে আইসক্রিম বিক্রিও শুরু করেন তিনি। শীঘ্রই সারা গুজরাতে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। ভাদিলালের মৃত্যুর পর তার ছেলে রঞ্ছোড়লাল গান্ধী ব্যবসার দায়িত্ব নেন। ৭০-এর দশকে ব্যবসা আরও ফুলেফেঁপে ওঠে। ছোট সেই দোকান শীঘ্রই সাম্রাজ্যে পরিণত হয়।

বর্তমানে এই সংস্থা ২০০টিরও বেশি বিভিন্ন স্বাদের আইসক্রিম তৈরি করে। ৪৯-এরও বেশি দেশে এই সংস্থার দোকান রয়েছে। ২০১৯-২০-র অর্থবর্ষে এই সংস্থার আয় হয়েছিল ৬৫০ কোটি। উল্লেখযোগ্য যে, ভাদিলাল বর্তমানে আমেরিকার সবচেয়ে বড় আইসক্রিম উৎপাদক সংস্থায় পরিণত হয়েছে।

বি রবি পিল্লাই। রবির জন্ম ১৯৫৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর কেরলের চাভারা গ্রামে এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে। কৃষিকাজ করেই রবির পরিবারের সংসার চলত। ছোটবেলা থেকেই অর্থাভাবের কারণে বহু সংগ্রামের মুখোমুখি হতে হয়েছে রবিকে।

কোচি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই রবি ব্যবসার দিকে ঝোঁকেন। সেই সময়ে তিনি স্থানীয় এক মহাজনের কাছ থেকে এক লক্ষ টাকা ধার নিয়ে নিজের চিটফান্ড কোম্পানি শুরু করেন। ব্যবসা থেকে অর্থ উপার্জনের পর সবার প্রথমে মহাজনের ঋণ শোধ করেন রবি। এর পর লাভের টাকা জমিয়ে হোটেল তৈরির কাজে হাত লাগান। জীবনে অনেক উত্থান-পতন দেখেছেন রবি। শ্রমিক ধর্মঘটের কারণে তাঁকে এক সময় দীর্ঘদিন ব্যবসা বন্ধও রাখতে হয়েছিল। কিন্তু রবি হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র ছিলেন না।

১৯৭৮ সালে রবি ভারত ছেড়ে সৌদি আরবে চলে যান। সেখানে পৌঁছে শীঘ্রই ১৫০ জন কর্মচারী নিয়ে নাসের এস আল হাজরি কর্পোরেশন (এনএসএইচ) নামে নিজস্ব নির্মাণ সংস্থা শুরু করেন। একটি ফরাসি বিমান সংস্থার কাছ থেকে বড় চুক্তি পাওয়ার পর রবির নির্মাণ ব্যবসা বহুগুণ বেড়ে যায়। কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও কঠিন সংগ্রাম এবং নিষ্ঠার জোরে রবি বর্তমানে এক লাখ ৯০ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকার মালিক। তার কোম্পানিগুলোতে প্রায় ৭০ হাজার কর্মচারী কাজ করেন।

পুনীত রেঞ্জেন। ১৯৮৯ সালে তিনি ‘দালোয়েত’ সংস্থার কর্মী হিসাবে যোগ দেন। বর্তমান তিনি সেই সংস্থারই সিইও। পুনীতের জীবনেও বাধাবিপত্তি কম ছিল না। কিন্তু সেই সব বাধা কাটিয়ে তিনি এখন এক জন সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী।

বাবা-মা স্কুলের খরচ বহন করতে না পারায় ছোটবেলাতেই ভালো স্কুল ছাড়তে বাধ্য হন পুনীত। পরে রোহতকের একটি স্থানীয় কলেজ থেকে তিনি স্নাতক হন। এরপর তিনি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে চাকরি খুঁজতে দিল্লি চলে যান।

দিল্লিতে থাকতে থাকতেই আমেরিকায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিতে যাওয়ার জন্যে যাওয়ার জন্য বৃত্তি পান পুনীত। দুইজোড়া প্যান্ট এবং কয়েকশো ডলার নিয়ে আমেরিকা পাড়ি দেন রেঞ্জেন। সেখানে গিয়ে কঠোর পরিশ্রম শুরু করেন তিনি।

আমেরিকায় একটি নামী পত্রিকায় সেরা দশ ছাত্রের তালিকায় পুনীতের নাম ছাপা হয়। ১৯৮৯ সালে ‘দালোয়েত’ সংস্থার তরফে চাকরির ডাক পান তিনি। ৩৪ বছর পর, আজ পুনীত সেই সংস্থার প্রধান। যা সম্ভব হয়েছে তার নিষ্ঠা, একাগ্রতা এবং পরিশ্রমের জন্য।

তুষার জৈন। বিলাসবহুল ব্যাগ প্রস্তুতকারী সংস্থা ট্রাওয়ার্ল্ড-এর মালিক তুষার ‌এখন কয়েকশো কোটি টাকার মালিক। কিন্তু তার জীবনের শুরুটা ছিল কণ্টকময়। ১৯৯২ সালে হর্ষদ মেহতার শেয়ার কেলেঙ্কারির শিকার হয়েছিলেন কয়েক হাজার মানুষ। তাদেরই একজন ছিলেন ঝাড়খণ্ডের ব্যবসায়ী মুলচাঁদ জৈন। সব হারিয়ে পরিবার নিয়ে পথে বসেছিলেন তিনি। তারই ছেলে তুষার।

সর্বস্ব খুইয়ে মুলচাঁদ ছেলের সঙ্গে মুম্বইয়ের রাস্তায় ব্যাগ বিক্রি করতে শুরু করেন। রাস্তায় রাস্তায় ব্যাগ বিক্রি করেই সংসার চালাতে শুরু করেন তিনি। ২০১২ সালে ট্রাওয়ার্ল্ড সংস্থা গড়ে তোলেন তুষার। এর মাত্র দুইবছরের মধ্যে বছরে ১০ থেকে ২০ হাজার ব্যাগ তৈরি করতে শুরু করে সংস্থাটি। তখন বছরে মোট ব্যবসা ছিল ৯০ কোটি টাকার।

২০১৭ সাল নাগাদ সংস্থার মোট ব্যবসা গিয়ে পৌঁছয় ২৫০ কোটিতে। প্রতি বছর ৩০ থেকে ৩৫ হাজার ব্যাগ তৈরি করতে শুরু করে সংস্থাটি। এই মুহূর্তে ভারতের চতুর্থ বৃহৎ ব্যাকপ্যাক এবং ব্যাগ বিক্রির সংস্থা এটি। এর সদর দফতর মুম্বইয়ে। সারা দেশে বিভিন্ন জায়গায় মোট ১০টি আলাদা অফিস রয়েছে। তুষারের সংস্থার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর বলি অভিনেত্রী সোনম কপূর।

ব্যর্থতা যেখানে বেশির ভাগ মানুষকে মানসিক ভাবে ভেঙে ফেলে, যারা নতুন করে সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠার সাহস হারিয়ে ফেলেন, তুষার তাদের সামনে অনন্য নজির। সাফল্যের শিখর থেকে শূন্যে নেমে আসার পর কী ভাবে শূন্য থেকে শুরু করে ফের শিখরে পৌঁছনো যায়, তা দেখিয়ে দিয়েছেন তিনি। জীবনে বহু বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাকে। সব পেরিয়ে আজ তিনি ২৫০ কোটি টাকার সংস্থার মালিক। কয়েক হাজার মানুষকে জীবনধারণের রসদ জুগিয়ে চলেছেন।

দক্ষিণ কোরিয়ার অন্যতম কোটিপতি সু-জিন। তার তৈরি করা ভ্রমণ অ্যাপ ইয়ানোলজা এখন সে দেশের অন্যতম ব্যবহৃত অ্যাপ। কিন্তু তার শৈশব ছিল অন্য রকম। শৈশবেই নিজের বাবা-মাকে হারান সু।

ইয়ানোলজা অ্যাপ তৈরির আগে তিনি হোটেলের দারোয়ান হিসাবেও দীর্ঘ দিন  কাজ করেন। ব্লুমবার্গের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৪৪ বছর বয়সি সু ২০০৫ সালে ইয়ানোলজা চালু করেন। অ্যাপ তৈরির পরও সেই অ্যাপকে দাঁড় করাতে তাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল।

জীবন কখনো হাল না ছেড়ে দেওয়া এবং নিজের উপর বিশ্বাস রেখে নিজের ভাগ্য তৈরি করার জলজ্যান্ত প্রমাণ ৩২ বছর বয়সি ব্যবসায়ী জোশ ফ্যাবিয়ান। জোশ গেমিং ওয়েবসাইট ‘মেটাফাই’র সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও।

আমেরিকার পিটসবার্গে এক দম্পতি জোশকে দত্তক নিয়েছিলেন। ছোটবেলা থেকে খুব কষ্ট করেই বড় হন তিনি। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই পড়াশোনার পাট চোকান জোশ এবং ২০ বছর বয়সে প্রথম বারের মতো তিনি বাবা হয়েছিলেন। সেই সময় জোশ এতই অর্থাভাবে ভুগছিলেন যে, তিনি এবং তার স্ত্রী বাচ্চার খিদে মেটাতে চুরি পর্যন্ত করতে শুরু করেন।

তবে পরিস্থিতি কাটিয়ে মেটাফাই ওয়েবসাইট খোলেন জোশ। কোভিড অতিমারির আবহে জোশের সংস্থা ফুলেফেঁপে ওঠে। ২০২২ সালের হিসাব অনুযায়ী, জোশের সংস্থার বর্তমান মূল্য প্রায় ৯০০ কোটি টাকা।

সূত্র: আনন্দবাজার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *