রাজপরিবারের যেসব ‘কেলেঙ্কারি’ নাড়িয়ে দিয়েছিল রানি এলিজাবেথকে

আন্তর্জাতিক

সেপ্টেম্বর ১০, ২০২২ ৯:০৯ পূর্বাহ্ণ

৭০ বছর রাজত্ব করার পর ব্রিটেনের সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদী রাজশাসক রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ব্যালমোরাল প্রাসাদে প্রিয়জনদের সান্নিধ্যে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তার বয়স হয়েছিল ৯৬ বছর।

দীর্ঘদিন ব্রিটিশ রাজসিংহাসনে থাকাকালে নানা ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী ছিলেন রানি এলিজাবেথ। একদিনে তিনি যেসব শক্তহাতে সামলেছেন শাসনভার, অন্যদিকে রাজপরিবারের ওপর দিয়ে আসা নানা ঝড়ঝাপ্টাও সামলাতে হয়েছে তাকে। তার মৃত্যুর পর নতুন করে সামনে এনেছে রাজপরিবারের সেইসব কেলেঙ্কারির কথা।

প্রিন্সেস ডায়না, প্রিন্স চার্লস এবং ‘তৃতীয় সেই ব্যক্তি’
প্রিন্সেস ডায়ানা ১৯৯৫ সালে বিবিসিকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে অভিযোগ করেছিলেন যে, ‘এই বিয়েতে আমরা তিনজন ছিলাম’–তিনি,  চার্লস এবং তার দীর্ঘদিনের প্রেমিকা ক্যামিলা। তাই জায়গা কম ছিল।’

সহজ কথায়, চার্লস ও ক্যামিলা পার্কার বোলসের মধ্যে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক নিয়ে ক্ষোভ উগরে দেন ডায়না। শুধু তাই নয়, জেমস হিউইট নামের নিজের এক প্রশিক্ষকের সঙ্গে সম্পর্কের কথাও স্বীকার করেন তিনি। দোদি আল-ফায়াদের সঙ্গে ডায়নার সম্পর্কের কথাও বহুল প্রচলিত। এহেন স্ক্যান্ডাল প্রকাশ্যে আশায় যারপরনাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন রানি এলিজাবেথ।

১৯৯৫ সালে অ্যান্ড্রু পার্কার বোলস ও ক্যামিলার বিচ্ছেদ হয়। এর মাত্র এক বছর পর ১৯৯৬ প্রিন্সেস ডায়ানা ও চার্লস তাদের সম্পর্কের ইতি টানেন।

১৯৯৭ সালে প্যারিসে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ডায়নার। তারপর ২০০৫ সালে ক্যামিলাকে বিয়ে করেন চার্লস। বিয়েতে উপস্থিতও ছিলেন রানি এলিজাবেথ। তবে ডায়নার প্রতি বিশেষ ভালবাসা না থাকলেও মন থেকে এই বিয়ে মেনে নিতে পারেননি রানি এলিজাবেথ।

প্রিন্সেস অ্যানের বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মেয়ে প্রিন্সেস অ্যান। বিখ্যাত অলিম্পিয়ান মার্ক ফিলিপের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। কিন্তু সেই সম্পর্ক সুখের ছিল না। প্রায় বিশ বছরের দাম্পত্যে ছেদ টেনে ১৯৯২ সালে তাদের ডিভোর্স হয়। এক ব্রিটিশ পত্রিকায় সেই বিয়েকে ‘আনন্দহীন নাটক’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়। তারপরই সংবাদমাধ্যমে ফাঁস হয়ে যায় অ্যানের বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের কথা। প্রকাশ পায় প্রাসাদে নিযুক্ত নৌসেনা কর্মী টিমোথি লরেন্সকে লেখা অ্যানের একাধিক চিঠি। এই কেলেঙ্কারির ফলেও ব্রিটিশ রাজপরিবারকে বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হয়।

প্রিন্স হ্যারির ভেগাস অ্যাডভেঞ্চার
ছোটবেলা থেকেই প্রথা ভাঙার দিকে ঝোঁক ছিল প্রিন্স হ্যারির। রাজপরিবারের কঠোর বিধিনিষেধ তার কাছে কঠিন মনে হতো। ২০ বছর বয়সে এক পার্টিতে নাৎসি পোশাক পরে বিতর্ক উসকে দিয়েছিলেন তিনি। যদিও পড়ে তার এহেন ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চেয়ে নেন হ্যারি। ২০১২ সালে ফের একবার বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন তিনি। লাস ভেগাসে তোলা প্রিন্স হ্যারির নগ্ন ছবি ছড়িয়ে পড়ে। ব্রিটিশ সেনার সদস্য হিসেবে আফগানিস্তানে যাওয়ার আগে ঘটা এই ঘটনায় রীতিমতো ধাক্কা খান ডিউক অব সাসেক্স হ্যারি। তার কথায়, দিনের শেষে হয়তো আমি নিজেকে অনেকটাই নামিয়ে এনেছি। আমার পরিবারের সমান ক্ষুণ্ণ করেছি। তবে আমার মনে হয়, রাজকুমারের থেকে বেশি করে সৈনিকের মনোভাব এসে যাওয়ায় এরকম হয়েছে।

আফগান যুদ্ধের আবহে এই ঘটনায় ব্রিটিশ জনতার মধ্যে যে সমালোচনার ঝড় উঠেছিলতার আঁচ অনেকটাই পৌঁছে গিয়েছিল বাকিংহাম প্যালেসে।

হ্যারি-মেগানের বিদ্রোহ
ব্রিটিশ রাজপরিবারে হ্যারি-মেগানের বিয়ে ছিল কার্যত ‘খোলা হাওয়ার’ প্রবেশ। কারণ, মেগানের শরীরে ছিল না রাজ-রক্ত। এছাড়া তিনি ছিলেন ডিভোর্সি মার্কিন অভিনেত্রী। তাই হ্যারির এহেন সাহসী পদক্ষেপে অনেকেই মনে করেছিলেন, এবার কিছুটা সংস্কার মুক্ত হবে রক্ষণশীল রাজপরিবার। ঐতিহ্য ও রাজকীয় আচার আচরণের লৌহ শৃঙ্খলের আবদ্ধ পরিবেশ হয়তো স্বাভাবিক হবে। কিন্তু তা হয়নি। নতুন প্রজন্মের এই বিদ্রোহী মনোভাব মেনে নিতে পারেননি রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। সাংসারিক বিবাদ এতটাই জটিল হয়ে ওঠে যে ২০২০ সালে রাজ পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা ঘোষণা করেন হ্যারি-মেগান। যা ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে ‘মেগজিট’ নাম পায়।

২০২১ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে একের পর এক বিস্ফোরক অভিযোগ করেন হ্যারি ও মেগান। রাজবধূ মেগান বলেন, এক সময় তিনি এমন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছিলেন, আত্মহত্যার কথাও মাথায় এসেছিল। কেবল মেগানই নন, প্রিন্স হ্যারিও  বাবার সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি নিয়ে মুখ খোলেন। ওই বিস্ফোরক সাক্ষাৎকারে কার্যত তোলপাড় হয় ব্রিটেন।

রাজপরিবার থেকে রাজকুমার অ্যান্ড্রুর নির্বাসন
ব্রিটিশ রাজপরিবারের কেলেঙ্কারির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রাজকুমার অ্যান্ড্রুর নির্বাসন। যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন তিনি। অ্যান্ড্রুর বিরুদ্ধে যৌন শোষণের অভিযোগ আনেন সমাজকর্মী ভার্জিনিয়া জুফরে। তিনি দাবি করেন, অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পরও তার সঙ্গে জোর করে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেন অ্যান্ড্রু। শুধু তাই নয়, অ্যান্ড্রু ও তার বন্ধু জেফরি এপস্টেইন তাকে ‘যৌনদাসী’ করে রেখেছিলেন বলেও বিস্ফোরক অভিযোগ করেন ভার্জিনিয়া।

এদিকে, বিতর্কের ঝড় না থামতেই মার্কিন ধনকুবের এবং নাবালিকা পাচার ও ধর্ষণের মামলায় অভিযুক্ত এপস্টেইনের সমর্থনে মুখ খোলেন অ্যান্ড্রু। ফলে শুরু হয় তুমুল সমালোচনা। প্রবল জনরোষের মুখে পড়েন তিনি। ২০২২ সালে মামলা চলাকালীন রাজপরিবারের অদস্য হিসেবে অ্যান্ড্রুর সমস্ত অধিকার ও সামরিক সম্মান কেড়ে নেওয়া হয়। নিজের নামের সঙ্গে আর ‘হিজ রয়েল হাইনেস’ শব্দগুলো ব্যবহার করতে পারবেন না তিনি বলেও জানিয়ে দেওয়া হয়। ছেলের এহেন কীর্তি রীতিমতো নাড়া দিয়েছিলে রানি এলিজাবেথকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *