পেটে ব্যথা, খাবারে অরুচি কিংবা ওজন কমে যাওয়ার মতো বিষয়গুলো কারো কারো কাছে বেশ উপেক্ষিতই বলা যায়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে এই অবহেলাই ডেকে আনে বড় বিপদ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এগুলোই হতে পারে পেটের প্রদাহজনিত রোগ বা আইবিডির উপসর্গ। এটি এমনই এক জটিল রোগ, যা একবার শরীরে বাসা বাঁধলে তা থেকে কখনোই মুক্তি মেলা সম্ভব নয়।
আইবিডির পূর্ণ রূপ হলো ইনফ্লেমেটরি বাওয়েল ডিজিজ। এ রোগটি মূলত পরিপাক বা গ্যাস্ট্রো ইন্টেসটিনাল (জিআই) ট্র্যাক্টের একটি দীর্ঘস্থায়ী ব্যাধি। এ রোগকে প্রদাহের বা ফোলার পর্যায়গুলোর মাধ্যমে চিহ্নিত করা হয়। রোগটি সারা জীবন ধরে রোগীকে বয়ে বেড়াতে হয়।
দীর্ঘমেয়াদি এ রোগে আক্রান্ত হলে প্রদাহ জিআই ট্র্যাক্টের ক্ষতি করে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি ডায়াবেটিসের মতো এ রোগটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে রোগীর সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফেরা সম্ভব বলে মনে করেন চিকিৎসকরা। এ রোগের আরও একটি সমস্যা হলো, এর চিকিৎসা পদ্ধতি অনেকটা ব্যয়বহুল।
অনুসন্ধানে পাওয়া যায় এ রোগে আক্রান্ত ৪৩ বছর বয়সী মুন্সীগঞ্জের জামালকে। বছর চারেক আগে আট লাখ টাকা খরচ করে জীবিকার তাগিদে পাড়ি দিয়েছিলেন মধ্যপ্রাচ্যে। কিন্তু পেটের প্রদাহজনিত রোগ আইবিডির কাছে হার মেনে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হন তিনি। ব্যয়বহুল চিকিৎসা খরচ মেটাতে বর্তমানে হারাতে বসেছেন তার ভিটেমাটিসহ আর্থিক সম্পত্তিও।
জামাল জানান, এ রোগে আক্রান্ত হয়ে ৬৫ কেজি থেকে এখন তার ওজন ৩৬ কেজি। শরীরে শুধু হাড়গুলোই দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল তার। দেশে এসে এ রোগের চিকিৎসা চালাতে গিয়ে আজ তিনি সহায়সম্বলহীন হয়ে পড়েছেন।
পেটের প্রদাহজনিত রোগ বা আইবিডির দুটি ধরন। একটি হলো আলসারেটিভ কোলাইটিস, যা প্রধানত বৃহদন্ত্রে প্রদাহ বা আলসার তৈরি করে। অন্যটি ক্রনস ডিজিজ, যাতে আক্রান্ত হতে পারে মুখ থেকে পায়ুপথ পর্যন্ত পরিপাকতন্ত্রের যেকোনো অংশ।
দুই ধরনের আইবিডিরই সাধারণ লক্ষণ-উপসর্গ হলো পেটে কিংবা মলদ্বারে ব্যথা, ডায়রিয়া, মলের সঙ্গে রক্ত যাওয়া, মৃদু জ্বর, ক্লান্তি ভাব, মুখে ঘা, গিরা ফোলা, খাবারে অরুচি ও ওজন কমে যাওয়া।
এ রোগে আক্রান্ত এক রোগী জানান, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সারা দিনে ৩০-৫০ বার টয়লেটে যেতে হয় তার। সেই সঙ্গে থাকে বমিভাব, খাবারে অরুচি। খাবার গ্রহণের অভাবে শরীর দুর্বল হওয়ার কারণে তার হাঁটতে চলতে সমস্যা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাকে থাকতে হয় শয্যাশায়ী।
দেশে দিন দিন বেড়ে চলা আইবিডিতে আক্রান্ত হতে পারেন যেকোনো বয়সের মানুষই। তবে তরুণদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি। রোগটির প্রকৃত কারণ এখনো অজানা।
তবে বলা হয়ে থাকে, বংশগত বা জেনেটিক কারণে কেউ কেউ এ রোগের ভুগতে পারেন। আবার ভাজাপোড়া, উচ্চ চর্বিযুক্ত খাবার, জাঙ্কফুড, ফাস্টফুড, ধূমপান, মদ্যপান আইবিডিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্পূর্ণ নিরাময় না হলেও আগেভাগে রোগ শনাক্ত ও সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে আইবিডি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। আর অবহেলা ডেকে আনতে পারে ক্যানসার।
এ বিষয়ে শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান বলেন, ডায়াবেটিস, অ্যাজমা, ব্লাড প্রেশারের মতো এই রোগটিকেও নিয়ন্ত্রণে রেখে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সম্ভব। তবে রোগটি সম্পূর্ণ নিরাময় না হওয়ার কারণে সারা জীবন এ রোগের ব্যয়ভার বহন করতে হওয়ায় রোগীর চিকিৎসা খরচ অনেকটা ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে।
তিনি আরও জানান, চিকিৎসা ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে যদি রোগী চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করতে অনীহা বা দেরি করে, তবে এ রোগ ক্যানসার, খাদ্যনালি চিকন হওয়া, খাদ্যনালি ফুটো হয়ে যাওয়ার মতো জটিল রোগের দিকে এগোতে শুরু করে। যার কারণে রোগীর মধ্যে দেখা যেতে পারে রক্তবমি, পায়খানার সঙ্গে রক্ত যাওয়ার মতো জটিল উপসর্গও।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. খালেকুজ্জামান সরকার বলেন, রোগীর রক্তবমি, পায়খানার সঙ্গে রক্ত যাওয়ার মতো রক্তক্ষরণের জটিল উপসর্গ দেখা দিলে রোগী যদি অবহেলা করেন, তবে রোগীর প্রথমে রক্তশূন্যতা দেখা দেবে।
যা পরবর্তী সময়ে রোগীর জীবনকে সংকটাপন্ন করে তুলতে পারে। আর ক্রনস ডিজিজের মারাত্মক পর্যায়ে রোগীর পায়খানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। যার কারণে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না রোগীর। ক্ষেত্রবিশেষে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে বলে জানান তিনি।
তাই আইবিডির ঝুঁকি এড়াতে শাকসবজি, ফলমূল, সুষম খাবার ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে বসবাস, নিয়মিত ব্যায়ামের ওপর জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। সেই সঙ্গে সর্বস্তরের মধ্যে জনসচেতনতাই এ রোগ প্রতিহত করতে পারে বলে মনে করেন তারা।