পদ্মাসেতু ঘুরিয়েছে শরীয়তপুরের অর্থনীতির চাকা

পদ্মাসেতু ঘুরিয়েছে শরীয়তপুরের অর্থনীতির চাকা

দেশজুড়ে

জানুয়ারি ১৮, ২০২৩ ১০:৪২ পূর্বাহ্ণ

‘পদ্মাসেতু ঘিরে অপার সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে শরীয়তপুরে। বিশেষ করে পরিবহন খাতে প্রায় ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। সেতু উন্মুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবহন খাতও নতুন রূপে আবির্ভূত হয়েছে।’ কথাগুলো বলছিলেন পরিবহন ব্যবসায় আসা নতুন উদ্যোক্তা শরীয়তপুর সুপার সার্ভিস প্রাইভেট কোম্পানির অংশীদার সাইম মোল্লা। তার মতো অনেকেই বলেছেন, শুধু পদ্মাসেতুকে ঘিরে শরীয়তপুরে অপার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এই সেতু শুধু যোগাযোগের দ্বারই উন্মুক্ত করেনি; শিল্প, সংস্কৃতি ও পর্যটন শিল্পসহ নানা ব্যবসার প্রসার ঘটিয়ে অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে। বলা চলে শরীয়তপুরের অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়েছে পদ্মাসেতু।

উদ্যোক্তা ও ভোজেশ্বর ইউপি চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম শিকদার বলেন, মাছ, গরু, কৃষিপণ্য, মসলাসহ আমাদের উৎপাদিত অন্যান্য পণ্য শরীয়তপুরের বাইরে নেয়া ছিল ব্যয়বহুল ও কষ্টসাধ্য। আমরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হতাম। ফলে কৃষি সেক্টর ছিল অনেকটাই অলাভজনক। পদ্মাসেতু চালু হওয়ার পর আমাদেরও যোগাযোগের সংকট কেটে গেছে।

এ বিষয়ে শরীয়তপুর চেম্বার অব কমার্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফারুক আহমেদ তালুকদার বলেন, পদ্মাসেতুকে ঘিরে এরই মধ্যে পরিবহন খাতে প্রায় ২০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ হয়েছে। পরিবহন খাতের মতো সবক্ষেত্রে লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া।

শরীয়তপুর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি, নড়িয়া উপজেলা চেয়ারম্যান একেএম ইসমাইল বলেন, পর্যটন কেন্দ্রকে ঘিরে থ্রি-স্টার মানের হোটেল-মোটেল তৈরি হবে। গার্মেন্টস, মাঝারি শিল্প, মৎস্য, গবাদিপশু, কৃষিখাত, পরিবহন খাতসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এরই মধ্যে অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে, যা শুধু এ অঞ্চলের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করবে না, ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে জীবনমানের উন্নয়ন হবে। তাই পদ্মাসেতু শরীয়তপুরের জন্য শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি।

জাজিরা উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ জামাল হোসেন বলেন, পদ্মাসেতু উদ্বোধনের ফলে কর্মব্যস্ততায় চঞ্চল হয়েছে দক্ষিণের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। বাংলাদেশের দক্ষিণে অর্থনৈতিক মূলত কৃষিকে ঘিরে। জীবন ও জীবিকার প্রতিটি ক্ষেত্রে রয়েছে কৃষির ছোঁয়া। তাই কৃষির পরিবর্তন মানেই এখানের জীবন ও জীবিকার পরিবর্তন। যে স্বপ্ন নিয়ে পদ্মাসেতু উদ্বোধন হয়েছে সেই শরীয়তপুরের কৃষি নতুন করে বদলে যেতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে তার সুফল ভোগ করছেন জাজিরাসহ শরীয়তপুরের কৃষি উদ্যোক্তা ও কৃষকসহ ব্যবসায়ীরা। জাজিরায় ধান, পাট, নানা প্রকারের সবজি, ফল, আলু, মিষ্টি আলু, চিনাবাদাম, সরিষার মতো ফসল। দক্ষিণাঞ্চলসহ অন্যান্য এলাকায় শীতকালীন ও গ্রীষ্মের সবজি সরবরাহে জাজিরা উপজেলা অন্যতম।

ছবি: ডেইলি বাংলাদেশ

তিনি আরো বলেন, উপজেলায় বছরে প্রায় তিন হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ হয়ে থাকে নানা ধরনের সবজি। এ উপজেলায় সারা বছরই দেখা মেলে বেগুন লাউ, টমেটো, শসা, করলা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকচু, পানিকচু, লতিকচু, লালশাক, পালং শাক, পুঁইশাক, পেঁপে, কাঁচকলা, মিষ্টি কুমড়োসহ নানা ধরনের সবজির। সবজি ছাড়াও এই এলাকায় আম, কলা, মাল্টা, পেঁপে, পেয়ারা, লেবু, ড্রাগনসহ নানা প্রকারের ফলের চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা এলাকার ফল ও সবজির ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে সবজি চলে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। উপজেলার মিরাশা চাষি বাজার, সূর্যমনি বাজার, আনন্দ বাজার, জয়নগরের বাজারসহ বিভিন্ন হাটে উঠছে এসব সবজি।

কৃষিবিদ জামাল হোসেন বলেন, স্বপ্নের পদ্মাসেতুকে নিয়ে কৃষির সম্ভাবনা নিয়ে মোট দাগে তিন ধরনের পরিবর্তন আমরা প্রত্যাশা করছি। এক. জাজিরায় বর্তমানে যেসব সবজির আবাদ হয় তার বাইরেও উচ্চমূল্যের বিভিন্ন সবজি ও ফলের আবাদ বৃদ্ধি পাবে যেমন ক্যাপসিকাম, মাশরুম, স্কোয়াশ, ব্রকলি, লেটুস, বিভিন্ন প্রকার ফল ও ফুলের আবাদ। এর মধ্যে অনেকেই যা চাষের উদ্যোগ নিয়েছে। দুই. কৃষির বাজার ব্যবস্থাপনা একটি চমৎকার পরিবর্তন শুরু হয়েছে- যেমন, কৃষকের সঙ্গে ঢাকা ও দেশের অন্যান্য বাজারের দূরত্ব কমে গেছে। আগে যেখানে ফেরির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো, অনেক সময় কাঁচা সবজি পচে যেত। আজ সেখানে অপেক্ষার প্রহর শেষ। বিকেলে সবজি উত্তোলন করে সন্ধ্যায় ঢাকার বাজারে প্রবেশ করছে জাজিরায় উৎপাদিত সবজি। ফলে কৃষকের খরচ কমছে এবং বিক্রয়মূল্য বেড়ে লাভ হচ্ছে বেশি। তিন. কৃষি পণ্য প্রসেসিং এবং রফতানিমুখী করণ হবে। নিরাপদ সবজি উৎপাদন করে দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে রফতানি করতে পারলে একদিকে যেমন কৃষি পণ্য প্রসেসিং এ সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যাবে।

কৃষি বিজ্ঞানী বীর মুক্তিযোদ্ধা কবি মফিজুল ইসলাম বলেন, কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের উন্নয়নের পূর্ব শর্ত হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। পদ্মাসেতু সেই যোগাযোগের ব্যবস্থার পালের দিয়েছে নতুন হাওয়া, যা শরীয়তপুরের কৃষিকে অনেক দূর এগিয়ে নিচ্ছে।

ছবি: ডেইলি বাংলাদেশ

জেলা প্রশাসক মো. পারভেজ হাসান বলেন, পদ্মাসেতুকে ঘিরে শরীয়তপুরে অপার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে অনেকগুলো বৃহৎ শিল্প এখানে আসার অপেক্ষায় আছে। জেলা ব্র্যান্ডিং হিসেবে জাজিরার কালোজিরা, মধু, মৃৎশিল্পের টেরাকোটা ও কাঁসা-পিতল শিল্পকে আমরা বিভিন্ন অনলাইন সাইট ই-কমার্সে দিয়েছি। সেগুলো এখন দেশ এবং দেশের বাইরে বিক্রি হচ্ছে। ২০২৩ সালে পদ্মাসেতুকে কেন্দ্র করে ইউকে ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রফতানি হবে জাজিরার কৃষিপণ্য।

পানিসম্পদ উপমন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীম বলেন, স্বপ্নের পদ্মাসেতু চালু হওয়ায় শরীয়তপুর হচ্ছে আধুনিক ও স্বনির্ভর জেলা। এরই মধ্যে শরীয়তপুরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিয়েছেন। এখানে শিক্ষা, সংস্কৃতি, কৃষি, পরিবহন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প কারখানা হবে। সামগ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যকে ঘিরে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে শরীয়তপুর ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। সব মিলে শরীয়তপুর উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *