নারী ফুটবলের সাফল্য হাইজ্যাকের হাস্যকর চেষ্টা বিএনপির

রাজনীতি

সেপ্টেম্বর ২২, ২০২২ ৫:৫৬ অপরাহ্ণ

আদম তমিজী হক

বাংলাদেশে নারী ফুটবল দল সাফ শিরোপা জিতে দেশে ফিরেছে। বাংলাদেশের নারী ফুটবলে যা সবচেয়ে বড় সাফল্য। মেয়েদের এমন কৃতিত্বে এখন উচ্ছ্বসিত পুরো দেশ। জাতীয় বীর হয়ে তাদের সাফল্যগাঁথা অর্জন এখন, টক অব দ্য কান্ট্রি !

নেপালের কাঠমুণ্ডু থেকে ট্রফি নিয়ে দেশে ফেরার পর চলছে ফুটবলারদের নিয়ে উচ্ছ্বাস। সেই সঙ্গে মেয়েদের এই সাফল্যে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টাও করছে কোনো কোনো মহল। ছিনতাইয়েরও চেষ্টা করছে মেয়েদের সাফল্যের এমন কৃতিত্ব। যেমন- আমাদের দেশের অন্যতম বড় নামধারী রাজনৈতিক দল বিএনপি (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল)। এই দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দাবি করেছেন, সাফ গেমসে নারী ফুটবল চালু করেন প্রেসিডেন্ট জিয়া!

মির্জা ফখরুল নারী ফুটবল দলকে অভিনন্দন জানিয়ে যেন গল্প বলা শুরু করলেন। আষাঢ় মাস কেবল চলে গেল। কিন্তু আষাঢ়ে গল্পের অবতারণা করে নিজের সাংস্কৃতিক বোধকে তিনি যেভাবে উপস্থাপন করলেন, তাতে করে তিনি ছোট হয়ে গেলেন। তাঁকে বলা দরকার, মশাই এখন আষাঢ় মাস নয়!

মির্জা ফখরুল গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ-সম্মেলনে নারীদের সাফ গেমসের সূচনা নিয়ে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের অবদান নিয়ে যে দাবি করলেন, সেটা নিতান্ত হাস্যকর আর সত্যের অপলাপ ছাড়া আর কিছু না।

মির্জা ফকরুলের মিথ্যাচার প্রমাণে শুরুতেই বলতে হয় ‘সার্ক’ এর কথা। দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণাটি সর্বপ্রথম ১৯৮০ সালে উত্থাপিত হয়। ১৯৮১ সালের এপ্রিলে, ৭ টি প্রতিষ্ঠাতা দেশ বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কার পররাষ্ট্র সচিবগণ কলম্বোতে মিলিত হন। যা পূর্ণ বাস্তবায়ন হয় ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বরে।

‘সার্ক’ প্রতিষ্ঠার শুরুর পর্যায়ে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ছিলেন জিয়াউর রহমান। কিন্তু ‘সার্ক’ নামক আঞ্চলিক সংগঠনটি পূর্ণ বাস্তবায়নের আগেই জিয়াউর রহমান আততায়ীদের হাতে নিহত হন। তাই সার্কে তাঁর অবদান ১৯৮১ সালের ৩০ মে পর্যন্ত। তিনি নিজের জীবদ্দশায় সার্কের পথচলা দেখে যেতে পারেননি। সার্কের পথচলা শুরু হয় এরশাদ সরকারের আমলে।

সার্ক জন্মের ইতিহাসে শুরুর পরিকল্পনা ছাড়া যেখানে জিয়াউর রহমানের সংশ্লিষ্টতা নেই, সেখানে সাফের নারী ফুটবল কীভাবে তিনি চালু করলেন? মির্জা ফখরুলই বা কিভাবে এই হাস্যকর দাবী করলেন?

মির্জা ফখরুল নিজের দাবির পেছনে সাক্ষী মেনেছেন কামরুন নাহার ডানাকে। যিনি বাংলাদেশের নারী ব্যাডমিন্টনের কিংবদন্তি । দায়িত্ব পালন করেছেন মহিলা ক্রীড়া সংস্থা ও ব্যাডমিন্টন ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদকের।

মির্জা ফখরুলের খুব সম্ভবত মনে পড়েছে, কামরুন নাহার ডানা কোনো এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন প্রথম টুর্নামেন্টটা বেগম খালেদা জিয়ার সরকারের সময় অনেক বাধা বিপত্তিকে উপেক্ষা করে শুরু হয়!

মির্জা ফখরুল মিথ্যা বলেছেন। সভ্য মানুষ হিসেবে এমন শব্দ আমি ব্যবহার করব না। ওনার আসলে স্মৃতিবিভ্রম ঘটেছে। কিংবা, মির্জা ফখরুলের সাফ নারী ফুটবল নিয়েই জ্ঞানের অভাব রয়েছে। নয়ত তিনি জানতেন, সাফ নারী ফুটবলের প্রথম আসর অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১০ সালে। বাংলাদেশের মাটিতে। সেই সময়ে বাংলাদেশের শাসন আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে। খালেদা জিয়ার সরকারের কোনো কৃতিত্ব সেখানে আনার সুযোগই নেই।

এ ছাড়া মির্জা ফখরুল সংবাদ সম্মেলনে নাকে কান্না কেঁদেছেন মেয়েদের দারিদ্রতা নিয়ে। হ্যাঁ, বাংলাদেশের মেয়েদের প্রায় সবাই এসেছে হতদরিদ্র পরিবার থেকে। অনেকেই এক সময় মাঠঘাটে কাজ করেছে পরিবারের অন্ন যোগানে সহায়তার জন্য। কিন্তু বর্তমানে ফুটবল তাদের দিয়েছে মুক্তির পথ। বয়সভিত্তিক দল থেকে শুরু করে জাতীয় দলের মেয়েরা প্রায় সারাবছর ক্যাম্পে অনুশীলনে ব্যস্ত থাকে। ধীরে ধীরে তাদের জীবনমান উন্নত হচ্ছে। আরও হবে। এ কথা কী অস্বীকার করার কোন উপায় আছে যে, আমাদের একজন শেখ হাসিনা রয়েছেন। তিনি এখন বিদেশ সফররত। অথচ, নেপাল বধ করার জন্য ফাইনালের দিনে ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীর কাছে বার বার করে খবর নিয়ে মেয়েদের ফলাফল জানার জন্য উদগ্রীব ছিলেন। ইতোমধ্যে আমাদের মেয়েদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আমেরিকা থেকে ফিরে এসে শেখ হাসিনা পুরষ্কার দিয়েই নতুন সিদ্ধান্ত দিবেন বলে গুঞ্জন রয়েছে।

এদিকে বাংলাদেশের মেয়েরা এখন ঘরোয়া লীগে খেলার সুযোগ পাচ্ছে। সাফের সাফল্যে তাদের চাহিদা আরও বাড়বে। বাড়বে ফেডারেশন থেকে সুবিধা আর বোনাস। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন থেকে নারী ফুটবলাররা বেতন পান নিয়মিত। সেটিও নিশ্চিত বাড়বে।

অনেকেই ছেলেদের ফুটবলের পারিশ্রমিকের সাথে মেয়েদের পারিশ্রমিকের বিরাট পার্থক্য নিয়ে সমালোচনা করেন। এই বৈষম্য অবশ্যই ঠিক না। কিন্তু এটা শুধু বাংলাদেশের ঘটনা না। বিশ্ব ফুটবলেও এই ব্যবস্থা চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। ছেলের মধ্যে কিলিয়ান এমবাপ্পে ক্লাব থেকে বছরে বেতন পান ১২৫ মিলিয়ন ইউরো। আর মেয়েদের ফুটবলে বিশ্বের সর্বোচ্চ বেতন পান আমেরিকার ক্যারিল লয়েড । বছরে পাঁচ লাখ ইউরো। কি আকাশ পাতাল পার্থক্য!

ফুটবলের ক্ষেত্রে ছেলে-মেয়েদের বেতন কাঠামো তাই বাংলাদেশের একক সমস্যা না। বরং সারা বিশ্বের।

মির্জা ফখরুল বলেছেন, দারিদ্রতার কারণে মেয়ে ফুটবলাররা ভাল করে খেতে পায় না। সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আগে কি তিনি বা তাঁর দল সেই খবর রেখেছেন? নাকি দলের কোনো খেলোয়াড়ের নাম জানতেন! কখনও তো শুনি নাই , মেয়ে ফুটবলারদের জন্য একবেলা খাবার নিয়ে গেছেন তারা।

ম্যারাডোনা, পেলে, রোনালদিনি, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর মতো ফুটবলাররা বস্তির ভাঙা ঘরে খেয়ে না খেয়ে শুধু অধ্যাবসায় আর প্রতিভার জোরে দুনিয়া জয় করেছে। আমাদের মেয়েরাও সেই পথে আছে। কারো সাহায্য বা অনুকম্পা তাদের দরকার নেই। নিজেদের যোগ্যতা দিয়েই তারা নিজেদের অবস্থা ফেরাবে।

মেয়েদের জন্য সবচেয়ে বড় ভরসা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পৃথিবীতে ওনার মতো খেলাপাগল মানবিক মানুষ বিরল। যিনি বাংলাদেশের যে কোনো সাফল্যে শিশুদের মতো উল্লাস করেন। স্টেডিয়ামে উপস্থিত থেকে খেলোয়াড়দের ভরসা দেন, ‘আমি তোমাদের সাথে আছি। তোমরা এগিয়ে যাও।’ সাফ ফুটবলের শিরোপা জয়ের পরে নারী ফুটবলারদের জন্যেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিশেষ কিছু পরিকল্পনা করবেন, সন্দেহ নেই। মেয়েদের সেটি পাওনাও।

আদম তমিজী হক : রাজনীতিক, সমাজকর্মী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *