দরিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করে বিশ্বকাপের মহামঞ্চে এমিলিয়ানো মার্টিনেজ

দরিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করে বিশ্বকাপের মহামঞ্চে এমিলিয়ানো মার্টিনেজ

খেলা

নভেম্বর ১৯, ২০২২ ৮:৫১ পূর্বাহ্ণ

তিন বছর আগেও এমিলিয়ানো মার্টিনেজকে তেমন কেউ চিনতেন না। কোপা আমেরিকায় রূপকথার জন্ম দেওয়ার আগে এমি ছিলেন পাদপ্রদীপের আড়ালে লুকায়িত এক চরিত্র। যে চরিত্রের ভাঁজে ভাঁজে দারিদ্র্যতার গল্প। দারিদ্র্যতার সঙ্গে লড়াই করা ছেলেটাই এখন প্রতিনিধিত্ব করবেন বিশ্বকাপের মহামঞ্চে।

এমির জীবনে ফ্রেমে বাধাই করে রাখার মতো তারিখটা হতে যাচ্ছে – ২২ নভেম্বর, ২০২২। বিশ্বকাপে সেদিন সৌদি আরবের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ খেলবে আর্জেন্টিনা, স্বপ্নপূরণ হবে তার। ৮০ হাজার দর্শকের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিচ্ছবি আরো একবার দেখবেন তিনি। বিশ্বকে জানিয়ে দেবেন নিজের শ্রেষ্ঠত্ব।

জীবনের গল্পে শ্রেষ্ঠত্বের আগে এমির জীবনে ছিল লড়াইয়ের এক কঠিন যাতাকাষ্ঠ। সেটা পেরিয়ে আসার আনন্দ ঝিলিক দিচ্ছিল তার চোখেমুখেও। জাতীয় দলের হয়ে আরেকটি বড় আসরে প্রতিনিধিত্ব করার আগে এমি বলেন, ‘নিজেকে তখন (বিশ্বকাপে খেলতে নেমে) বলবো, আমি করতে (স্বপ্নপূরণ) পেরেছি।’

কাতারে শিরোপা জিততে যাচ্ছেন জানিয়ে এমি বলেন, ‘আমরা ওখানে শিরোপা জিততেই যাচ্ছি। এটা হবে আমার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে কঠিন ম্যাচ। হয়তো আমি যখন জাতীয় সঙ্গীত শুনবো, চোখে জল জমা হবে। আমি আর্জেন্টাইন হয়ে অনেক বেশি গর্বিত। নিজের, পরিবারের জন্য দিনটি হবে ভীষণ গর্বের।’

জীবনে কঠিন এক বছর কাটিয়ে এসেছেন এমি। বাবা আলবার্তো হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এখন তিনি অনেকটাই সুস্থ। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে গাইতে বাবার মুখ দেখতে চান এমি, ‘প্রথম ম্যাচের জন্য যখন জাতীয় সঙ্গীত গাইবো, বাবার মুখটা দেখতে চাই। উনি থাকবেন, এটা হবে অসাধারণ এক ব্যাপার।’

এমির জন্য বিশ্বকাপটা কতটা বিশেষ? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চলে যেতে হবে তার ছোটবেলায়। বুইন্স আইরেসের দক্ষিণে মার ডেল প্লাটা নামে একটা জায়গায় বেড়ে উঠেছেন। শৈশব থেকেই দারিদ্র্যটা ছিল তার নিত্য সঙ্গী। সেটা কেমন? আর্থিক সামর্থ্যের অভাবে বাথরুমের দরজাও লাগাতে পারেননি তার মা-বাবা।

প্রতি বেলায় খাবার পাওয়ার নিশ্চয়তা ছিল না। পাওয়া গেলেও সবার ভাগে জুটতো না। এমি ছোটবেলায় স্কুলে ছুটতেন, তখন তার মা যেতেন অন্য কারো অ্যাপার্টমেন্ট পরিষ্কার করতে। আর বাবা কখনও কখনও ২০ ঘণ্টার বেশি ট্রাক চালাতেন মাছ ভর্তি করে। কেবল সন্তানের মুখে দু’মুঠো আহার দেবেন বলে।

এমির জীবনে লড়াইটা শুরু হয় ১২ বছর বয়স থেকে। ইন্ডিপেন্ডেন্টের হয়ে খেলতে ঘর ছাড়েন এই গোলরক্ষক। টাকার অভাবে তাকে তখন দেখতে যেতে পারতেন না বাবা-মা। ১৭ বছর বয়সে তাকে বিক্রি করা হয় আর্সেনালে। এমি বুঝতে পেরেছিলেন কিছু করার নেই। পরিবারের দিকে তাকিয়ে পিছু ফিরেননি। তাকে বিক্রির ওই টাকা দিয়ে গাড়ি কিনেছিলের তার বাবা।

এরপর আর টাকার জন্য কখনো পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। স্মৃতির পাতা উলটাতে থাকেন এমি, “যখন লন্ডনে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম, আমার মা সুসানা ও ভাই আলেহান্দ্রো কান্না করতে করতে বলেছিল, ‘যেও না।’ কিন্তু আমি আমার বাবাকেও রাতে কাঁদতে দেখেছি বিল না দিতে পেরে। তাই আমি ‘হ্যাঁ’ বলেছিলাম বাবা-মায়ের ভালোর জন্য।’’

ইংল্যান্ডের জীবনও বেশ কঠিনই কেটেছে এমির। অক্সফোর্ড ইউনাইটেড, শেফিল্ড ওয়েডনেসডে, রোথারাম ইউনাইটেড, ওলভস, রিডিং, স্পেনের গেতাফেতে ধারে খেলেই কাটিয়ে দিয়েছেন প্রায় পুরো সময়। এরপর ২০১৯-২০ মৌসুমে ব্রেন্ড লেনোর ইনজুরিতে সুযোগ পেয়ে ১১ ম্যাচ খেলে আর্সেনালের এফএ কাপ জয়ে রাখেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এর কয়েক সপ্তাহেই চলে আসেন ভিলায়।

এমিকে অবশ্য বেশি পরিচিতি এনে দিয়েছে জাতীয় দল। আর্জেন্টিনার জন্য তিনিও নিবেদিত প্রাণ। গত সপ্তাহেই যেমন ২-১ এ ব্রাইটনকে হারিয়েছে তার ক্লাব অ্যাস্টন ভিলা। এরপর সতীর্থ মাতি কেশ ও জন বেডনারেক বলেছিলেন, দেখো, তুমি বিশ্বকাপে আছো।

তারা দুজন আবার পোল্যান্ডের। যাদের সঙ্গে বিশ্বকাপে একই গ্রুপে পড়েছে আর্জেন্টিনা। এরপর এমি সতর্কই করে দিয়েছেন তাদের, ‘তোমার ইচ্ছের ব্যাপারে সতর্ক থেকো।’ পরে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, ‘আমরা সতীর্থ কিন্তু যখন বিপক্ষে খেলবো, আমি যুদ্ধে আছি এমন ভেবে নেবো।’

আর্জেন্টিনা সবশেষ উল্লাস করেছিল ৩৬ বছর আগে। তাহলে কি ১৯৮৬ সালের পর আরও একটি শিরোপা জিততে যাচ্ছে আর্জেন্টিনা? এমির ভাষায়, ‘পৃথিবীর সেরা ফুটবলার লিওনেল মেসি আমাদের আছে। তো অবশ্যই সুযোগ আছে। ৩৫ ম্যাচ হারিনি। আত্মবিশ্বাস আর দুটি শিরোপা সঙ্গী করে যাচ্ছি। আমরা লড়তে পারি, খেলতেও। ’

তবে আরেকবার উল্লাস হোক। দারিদ্র্যতাকে জয় করে যে আনন্দাশ্রুটা ঝরিয়েছেন, সেটা আরেকবার ফিরে আসুক কাতারের ধু ধু মরুভুমির বুকে।  এমন আনন্দ শুধু এমিকেই মানায়, কেবল এমিলিয়ানো মার্টিনেজকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *