টাইফয়েড বা প্যারাটাইফয়েড জ্বর হলে কী করবেন

স্বাস্থ্য

সেপ্টেম্বর ৩, ২০২২ ১১:১১ পূর্বাহ্ণ

টাইফয়েড ও প্যারাটাইফয়েড জ্বর প্রাণ-সংশয়কারী অসুস্থতা হতে পারে। প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী টাইফয়েড জ্বরের আনুমানিক ১১-২১ মিলিয়ন রোগী এবং প্যারাটাইফয়েড জ্বরের ৫ মিলিয়ন রোগী আক্রান্ত হয়। এ থেকে আনুমানিক ২ লাখেরও বেশি রোগীর মৃত্যু হয়। জরিপে দেখা গেছে, পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়া (বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত ও পাাকিস্তান), আফ্রিকা, ক্যারিবিয়ান, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যে ভ্রমনকারীদের টাইফয়েড ও প্যারাটাইফয়েড জ্বর হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। এছাড়া আরও কিছু কারণে রোগটি হতে পারে। এ নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন অধ্যাপক ডা. মনজুর হোসেন

সালমোনেলা টাইফি টাইফয়েড জ্বর এবং সালমোনেলা প্যারাটাইফি (প্যারাটাইফি এ), এস. স্কটমুয়েলেরি (প্যারাটাইফি বি), বা এস. হিরশফেল্ডি (প্যারাটাইফি সি) প্যারাটাইফয়েড জ্বরের কারণ। উপরোক্ত জীবাণু সংক্রামিত মানুষের মল দ্বারা দূষিত খাবার বা পানি খাওয়ার ফলে এ সংক্রমণ ঘটে। অর্থাৎ টাইফয়েড জ্বর পানি ও খাদ্যবাহিত সংক্রামক রোগ। টাইফয়েড ব্যাকটেরিয়া দূষিত খাবার বা পানির মাধ্যমে মুখ দিয়ে প্রবেশ করে অন্ত্রে পৌঁছায় এবং ধীরে ধীরে রক্তপ্রবাহের মাধ্যমে সংক্রমণ শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে, টাইফয়েড জ্বরের বিভিন্ন উপসর্গ এবং লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়। আর এ জন্যই টাইফয়েড জ্বরকে অন্ত্রের জ্বরও (ঊহঃবৎরপ ঋবাবৎ) বলা হয়। টাইফয়েড-আক্রান্ত রোগীদের মল বা প্রস্রাবে এ জীবাণু থাকে এবং পানি সরবরাহ ব্যবস্থাকে দূষিত করতে পারে, বিশেষ করে বর্ষাকালে। কম রান্না করা খাবার, কাঁচা ডিম, শাকসবজি বা দূষিত দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্যও সালমোনেলা সংক্রমণের উৎস হতে পারে। যদি চিকিৎসা না করা হয় তবে অন্ত্রের (astrointestinal) এবং মস্তিষ্কের ও স্নায়ুর (Brain & Nervous System) সঙ্গে সম্পর্কিত জটিলতা হতে পারে।

ষজ্বরের ধরন

জ্বরের তীব্রতা কম থেকে মাঝারি ও উচ্চমাত্রার হতে পারে এবং ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে পারে। জ্বরের উচ্চমাত্রায় শিশুরা সাধারণত দুর্বল ও নিস্তেজ হয়ে পড়ে। বমি, পাতলা পায়খানা বা কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে। কারও কারও কাশির সঙ্গে শ্বাসকষ্টের লক্ষণ থাকতে পারে। জিহ্বা সাদা প্রলেপযুক্ত হয়। দ্বিতীয় সপ্তাহে, শিশুদের ত্বকে ‘রোজ স্পট’ নামে একটি অস্পষ্ট গোলাপি রঙের ফুসকুড়ি কদাচিৎ দেখা যেতে পারে যা চাপ দিলে বিবর্ণ হয়ে ওঠে। তবে এ র‌্যাশ ফর্সা ত্বকে ভালো বোঝা যায়।

ষপ্যাথোলজিক্যাল পরীক্ষা

শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে টাইফয়েড জ্বর নিশ্চিত হয়ে গেলে, অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা শুরু করতে হবে। ক্লিনিক্যাল ভিত্তিতে, চিকিৎসক দৃঢ়ভাবে টাইফয়েড সন্দেহ করলে, অ্যান্টিবায়োটিক সাধারণত ব্লাড কালচার রিপোর্ট পাওয়ার আগেই শুরু করা হয়। কারণ, ব্লাডকালচারের রিপোর্ট আসতে কমপক্ষে ৭২ ঘণ্টা সময় লাগে।

তবে মনে রাখতে হবে, অন্যান্য সংক্রমণের মতো ২-৩ দিনের মধ্যে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের মধ্যে দ্রুত হ্রাস করবে না, টাইফয়েড জ্বরে তাপমাত্রা ধীরে ধীরে হ্রাস পায় এবং সঠিক ওষুধ শুরু করার পরেও এক সপ্তাহ পর্যন্ত চলতে পারে।

অনেক ক্ষেত্রে, যদি রোগ নির্ণয় নিশ্চিত না হয়, তাহলে টাইফয়েড জ্বর ছাড়া অন্য কোনো সমস্যা আছে কিনা তা জানার জন্য আরও পরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে।

ষকখন হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন

টাইফয়েড জ্বরের সব ক্ষেত্রে ভর্তির প্রয়োজন নাও হতে পারে। টাইফয়েড জ্বরের কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষ করে যদি হালকা এবং তাড়াতাড়ি শনাক্ত করা হয়, তবে মুখের ওষুধে রোগ ভালো হয়।

টাইফয়েড মূলত অন্ত্রের একটি সংক্রমণ যাতে অন্ত্রনালি ফুলে যায়, তাই মুখে দেওয়া অ্যান্টিবায়োটিক (সিরাপ বা ট্যাবলেট) অনেক সময় ঠিকমতো শোষণ করতে পারে না। তাই কিছু ক্ষেত্রে, ওষুধগুলো সঠিকভাবে শোষিত হয় না এবং কাজ করতে ব্যর্থ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে শিরায় অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন দিতে হবে, সে ক্ষেত্রে অবশ্যই হাসপাতাল বা ক্লিনিকে ভর্তিকরা প্রয়োজন।

যদি শিশু খুব দুর্বল বোধ করে, ঠিকমতো খেতে না পারে অথবা বমি করে, তাহলে ইনজেকশনের মাধ্যমে এবং গ্লুকোজ বা স্যালাইন ইনফিউশনের জন্যও অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়ার জন্য ভর্তির প্রয়োজন হয়।

টাইফয়েড জ্বরের জটিলতায় আক্রান্ত শিশুদেরও সম্পূর্ণ চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয়।

টাইফয়েড জ্বর সঠিক চিকিৎসা এবং পুনরুদ্ধারের পরেও ৫-১০ শতাংশ রোগীর মধ্যে আবার জ্বর দেখা যায়। একে রিল্যাপস (জবষধঢ়ংব) টাইফয়েড বলে। এটি সাধারণত জ্বরের রেজোলিউশনের বা চলে যাওয়ার ২-৩ সপ্তাহ পরে ঘটে। কদাচিৎ, প্রাথমিক সংক্রমণের কয়েক মাস পরে, চিকিৎসার সময় বা পরে আবার টাইফয়েড হতে পারে। সাধারণত রিল্যাপস টাইফয়েড মূল টাইফয়েডের তুলনায় হালকা হয়। রিল্যাপস টাইফয়েড জ্বরও একই অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করা উচিত। খুব কম ক্ষেত্রে, টাইফয়েড জ্বরের একটি দীর্ঘস্থায়ী রিল্যাপিং ফর্ম অনেক মাস ধরে স্থায়ী হতে পারে, বিশেষ করে অ্যান্টিবায়োটিকের অপর্যাপ্ত ডোজ দিয়ে চিকিৎসা করা হলে।

ষপ্রতিরোধ ও প্রতিষেধক

যেখানে পয়ঃনিষ্কাশন বা স্যানিটেশন পরিকাঠামো অপর্যাপ্ত সেখানে টাইফয়েডের বিস্তার রোধ করার জন্য পানি, স্যানিটেশন এবং হাইজিন (WASH)-এর প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। তবে টাইফয়েড জ্বর প্রতিরোধের জন্য এ টিকা বা ভ্যাকসিন অতিরিক্ত সুরক্ষা প্রদান করে।

ষফুটানো পানি : যেহেতু টাইফয়েড রোগ পানি ও খাদ্যবাহিত রোগ এবং টাইফয়েড-আক্রান্ত রোগীদের মল বা প্রস্রাবে এ জীবাণু থাকে এবং পানি সরবরাহ ব্যবস্থাকে দূষিত করতে পারে, বিশেষ করে বর্ষাকালে। তাই পান করার আগে পানি ফুটিয়ে পান করতে হবে।

ষবাসি, খোলা বা কম রান্না করা খাদ্য, কাঁচা শাকসবজি বা দূষিত দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্যও খাওয়া পরিহার করা উচিত।

ষব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা যেমন, টয়লেট শেষে, খাওয়ার বা শিশুকে খাওয়ানোর আগে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া। একইভাবে, ব্যবহারের আগে প্লেট, বাটি, চামচ ইত্যাদি পরিষ্কার সাবান-পানি দিয়ে ধোয়া জরুরি।

ষটিকা : টাইফয়েড ভ্যাকসিন বা টিকা টাইফয়েড থেকে রক্ষা করে। বর্তমানে দুই ধরনের টাইফয়েড ভ্যাকসিন বাংলাদেশে পাওয়া যায়-টাইফয়েড পলিস্যাকারাইড ভ্যাকসিন এবং টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন। সাধারণত টাইফয়েড টিকা ২ বছরের বেশি বয়সের শিশুদের জন্য সুপারিশ করা হয়। এটি প্রতি ৩ বছর পরে পুনরাবৃত্তি করতে হবে। বিকল্পভাবে টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন বা টিসিভি শিশু ৬ মাসের পর থেকে দেয়া যায়।

নির্দেশিকা অনুসারে টিসিভির বুস্টারডোজ দেওয়ার দরকার হয় না। টাইফয়েড টিকা টাইফয়েড প্রতিরোধে সহায়তা করে। টাইফয়েড প্রতিরোধকারী বিভিন্ন ধরনের ভ্যাকসিন রয়েছে-আপনার শিশুর ক্ষেত্রে কোনটি উপযুক্ত তা জানতে আপনাকে সর্বদা আপনার শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।

লেখক : শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ এবং সভাপতি, বাংলাদেশ শিশু চিকিৎসক সমিতি ও সভাপতি, বাংলাদেশ শিশু সংক্রামক ব্যাধি সমিতি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *