চীনা মাইনিং কোম্পানির কবলে বিলুপ্তির পথে কাবুলেরবৌদ্ধ শহর

আন্তর্জাতিক স্লাইড

জুন ২৪, ২০২২ ৮:৪৩ পূর্বাহ্ণ

আফগানিস্তানে কাবুলের কাছে বিশাল চূড়া থেকে খোদাই করা একটি প্রাচীন বৌদ্ধ শহর বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে, কারণ এর একেবারেই কাছে বিশ্বের বৃহত্তম তামার খনিতে খনন শুরু করতে যাচ্ছে চীনের একটি মাইনিং প্রতিষ্ঠান।

হেলেনিস্টিক এবং ভারতীয় সংস্কৃতির মিশেলে অবস্থিত শহর ‘মেস আইনাক’কে এক-দুই হাজার বছর পুরনো বলে মনে করা হয়। শহরটি একসময় তামা উত্তোলন এবং বাণিজ্যসমৃদ্ধ একটি বিশাল শহর ছিল। প্রত্নতাত্ত্বিকরা এখানে বৌদ্ধ মঠ, স্তূপ, দুর্গ, প্রশাসনিক ভবন এবং বাসস্থান আবিষ্কার করেছেন। সেখানে শত শত মূর্তি, ফ্রেস্কো, সিরামিক, মুদ্রা এবং পাণ্ডুলিপিও আবিষ্কৃত হয়েছে।

শতাব্দীর শুরুতে সেখানে কিছু লুটপাট হওয়া সত্ত্বেও মেস আইনাক হল ‘বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলোর মধ্যে একটি’- এমনটি বলেছেন বাস্তিয়েন ভারুৎসিকোস, যিনি ফরাসি কোম্পানি আইকনেমের একজন প্রত্নতাত্ত্বিক। এই প্রতিষ্ঠানটি এই শহর এবং এর ঐতিহ্যকে ডিজিটাল করার জন্য কাজ করছে।

কিন্তু গত বছরের আগস্টে তালেবানরা ক্ষমতায় ফিরে আসার পর আন্তর্জাতিক সাহায্য বন্ধ হওয়ার পর নতুন রাজস্ব খাত খুঁজে বের করতে তারা এই তামার খনির খনন প্রকল্পটিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। এর ফলে প্রত্নতাত্ত্বিক এই শহরটি শেষ হয়ে যেতে পারে।

শহরে আবিষ্কৃত বস্তুগুলো প্রধানত খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় থেকে নবম শতাব্দীর মধ্যে তৈরি। ১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে একজন ফরাসি ভূতাত্ত্বিক দ্বারা এই শহরটি পুনঃআবিষ্কৃত হয়। লোগার প্রদেশের মেস আইনাক, আকার এবং তাৎপর্যের দিক থেকে পম্পেই এবং মাচু পিচুর সমকক্ষ বলেই মনে করা হয়। এই ধ্বংসাবশেষ এক হাজার হেক্টরজুড়ে, একটি বিশাল চূড়ার ওপরে অবস্থিত।

এই শহরের কাছেই অবস্থিত তামার খনিতে খননকাজ চালাতে ২০০৭ সালে মেটালার্জিক্যাল গ্রুপ করপোরেশন (এমসিসি) নামে চীনের একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কনসোর্টিয়াম ৩০ বছরের জন্য আফগানিস্তানের সঙ্গে একটি চুক্তি করে। এই চুক্তি অনুসারে আকরিক খনির জন্য আফগানিস্তান তিন বিলিয়ন ডলার পাবে।

তবে ১৫ বছর পার হয়ে গেলেও চুক্তির আর্থিক শর্তাবলি নিয়ে বেইজিং এবং কাবুলের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা এবং মতবিরোধের কারণে খননকাজ বিলম্ব হয়েছে।

তবে বর্তমানে প্রকল্পটি উভয়পক্ষের জন্যই অগ্রাধিকার পাচ্ছে এবং কীভাবে তা এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে তা নিয়ে আলোচনা চলছে। তাই এই আশঙ্কা বাড়ছে যে সিল্ক রোডের অন্যতম সমৃদ্ধ বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত স্থানটি, যেখানে এই মেস আইনাক অবস্থিত, তা কোনোরকম তদারকি ছাড়াই অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে।

ভারুৎসিকোস এএফপিকে বলেছেন, ২০১০ এর গোড়ার দিকে, এটি ছিল ‘বিশ্বের বৃহত্তম প্রত্নতাত্ত্বিক প্রকল্পগুলোর মধ্যে একটি’। যদিও চীনের ওই কোম্পানিটি প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাজ করার জন্য তিন বছরের জন্য মাইনিং অপারেশন শুরু স্থগিত করে। সে সময় হাজার হাজার প্রাচীন বস্তু উন্মোচিত হয়েছিল, কিছু কাবুল জাদুঘরে নেওয়া হয়েছিল, অন্যগুলো কাছাকাছি রাখা হয়েছিল।

সর্বশেষ ক্ষমতায় থাকাকালীন তালেবানরা ২০০১ সালের মার্চে বামিয়ানের বিশাল বুদ্ধ মূর্তিকে ধ্বংস করে বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল, কিন্তু তারা বর্তমানে মেস আইনাকের আবিষ্কারগুলো সংরক্ষণ করতে বদ্ধপরিকর বলেই জানিয়েছে। খনি ও পেট্রোলিয়াম মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইসমাতুল্লাহ বুরহান এএফপিকে বলেন, ‘তাদের রক্ষা করা তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব।’ এদিকে চীনারা ভূগর্ভস্থ খনি খনন না করে, উপরেই খননকাজ চালানোর পক্ষে। যদি তাই হয়, তবে অতীতের সব চিহ্ন একদম শেষ হয়ে যাবে।

প্রসঙ্গত, আফগানিস্তানে তামা, লোহা, বক্সাইট, লিথিয়ামের বিশাল মজুত রয়েছে যার মূল্য এক ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি।

তালেবানরা আশা করছে, মেস আইনাক থেকে বছরে ৩০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি আয় করবে, যা ২০২২ সালের জন্য পূর্ণ রাষ্ট্রীয় বাজেটের প্রায় ৬০ শতাংশ, তাই এখন প্রক্রিয়াটিকে তারা ত্বরান্বিত করতে চায়।

‘এই প্রকল্পটি অবশ্যই শুরু করতে হবে, এটিকে আর বিলম্বিত করা উচিত নয়’- সাম্প্রতিক তালেবান সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে বারবার চীনের মাইনিং কোম্পানিকে তাগাদা দিয়েছে। আলোচনা প্রায় ৮০ শতাংশ সমাপ্ত বলেও জানা গেছে।

তালেবান দাবি করছে, চুক্তির মধ্যে খনি এবং কাবুলকে মিলিত করে এমন একটি পাওয়ার স্টেশন নির্মাণ এবং পাকিস্তানের একটি রেলপথকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তারা আফগান কর্মীবাহিনীর সঙ্গে স্থানীয়ভাবে তামা প্রক্রিয়াকরণের জন্যও জোর দিয়েছে। তবে চীন এই চাহিদা মেটাতে নারাজ।

তামা খনন পরিবেশের জন্য দূষণকারী এবং এতে প্রচুর পরিমাণে পানির প্রয়োজন, এবং লোগার ইতোমধ্যেই একটি শুষ্ক অঞ্চল। বুরহানের মতে, তালেবান এই বিষয়গুলোতে ‘কঠোর মনোযোগ’ দিচ্ছে এবং নিশ্চিত করবে যে কনসোর্টিয়াম এই বিষয়ে তার বাধ্যবাধকতা পূরণ করে। তবে আপাতত এই বিলম্ব প্রত্নতাত্ত্বিকদের জন্য কিছুটা পরিত্রাণ।

যদিও বর্তমানে সাইটে কোনো কাজ চলছে না, তবে প্রত্নতাত্ত্বিকরা আশা করছেন খনির কাজ শুরু করার আগে খনন পুনরায় শুরু করা যাবে। তবে এটিও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং তহবিলের ওপর নির্ভর করবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *