গর্ভপাতের অধিকার কেড়ে নিলেন মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট

আন্তর্জাতিক

জুন ২৫, ২০২২ ১১:৩৫ পূর্বাহ্ণ

যুক্তরাষ্ট্রে লাখো নারী আর গর্ভপাতের আইনি অধিকার পাবেন না। সুপ্রিম কোর্ট দেশব্যাপী গর্ভপাতকে বৈধতা দেওয়া প্রায় ৫০ বছরের পুরোনো একটি আইনি সিদ্ধান্ত উল্টে দিয়ে নারীদের এই অধিকার কেড়ে নিয়েছে।

গত মাসের শুরুর দিকেই সুপ্রিম কোর্টের ফাঁস হওয়া একটি গোপন খসড়া নথিতে ঐতিহাসিক গর্ভপাত অধিকার আইন বাতিল হতে পারে বলে আভাস মিলেছিল। রাজনীতি বিষয়ক সংবাদমাধ্যম পলিটিকো সেই নথি প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত দেশব্যাপী গর্ভপাতকে বৈধতা দেওয়া ১৯৭৩ সালের আইনি সিদ্ধান্ত ‘রো বনাম ওয়েড’ উল্টে দেওয়ার পক্ষে রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা শিগগিরই এ বিষয়ে রায় ঘোষণা করতে পারেন।

শুক্রবার সে রায়ই শোনাল আদালত। রক্ষণশীল সংখ্যাগরিষ্ঠ সুপ্রিম কোর্ট নারীর গর্ভপাত অধিকার আইনটি বাতিল করে দিয়ে বলেছেন, এখন অঙ্গরাজ্যগুলো নিজেদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক গর্ভপাতের অনুমতি দিতে পারে অথবা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে।

ওই রায়ের পরপরই মিসৌরি প্রথম কোনো অঙ্গরাজ্য হিসেবে গর্ভপাত নিষিদ্ধ করেছে। তবে সুপ্রিম কোর্টের ওই রায়ের পর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি। তিনি সুপ্রিম কোর্টের রায়কে নির্মম আখ্যা দিয়ে বলেছেন, ‘আমেরিকার নারীরা আজ তাদের মায়েদের চেয়ে কম স্বাধীনতা ভোগ করছেন।’

বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাবেন শিগগিরই।

সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানায়, ১৩ টি রাজ্য আগে থেকেই গর্ভপাতকে অপরাধ হিসাবে গণ্য করতে আইন এবং সংবিধান সংশোধনের মতো পদক্ষেপ নিয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের এ রায়ের ফলে সেগুলো আপনা থেকেই গর্ভপাত নিষিদ্ধে কার্যকর হয়ে যাবে। আর অন্যান্য আরও অনেক রাজ্য শিগগিরই নতুন আইন পাস করবে।

সব মিলিয়ে দেশটিতে প্রজননক্ষম প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ নারী গর্ভপাতের অধিকার হারাতে পারে বলে হিসাব দেওয়া হয়েছে গর্ভপাত নিয়ে কাজ করা স্বাস্থ্যসেবা সংগঠন ‘প্ল্যানড প্যারেন্টহুড’ এর গবেষণায়।

মিসিসিপি রাজ্যের (গর্ভধারণের ১৫ সপ্তাহ পর) গর্ভপাত নিষিদ্ধের পদক্ষেপকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে নারীদের একটি স্বাস্থ্য সংগঠন ‘ডব্বস বনাম জ্যাকসনের’ করা মামলা পক্রিয়ায় সুপ্রিম কোর্ট এই রায় শুনিয়েছে।

কনজারভেটিভ-সংখ্যাগরিষ্ঠ আদালত আদর্শগত দিক থেকে মিসিসিপি রাজ্যর পক্ষেই রায় দেওয়ায় কার্যত গর্ভপাতের সাংবিধানিক অধিকারের অবসান ঘটেছে।

মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার সুপ্রিম কোর্টের রায়কে নির্মম আখ্যা দিয়ে বলেছেন, “আমেরিকার নারীরা আজ তাদের মায়েদের চেয়ে কম স্বাধীনতা ভোগ করছে।”

ওদিকে, অধিকার সংগঠন দ্য আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন এক টুইটে বলেছে, “আদালত কি বলেছে সেটি ব্যাপার না। কাউকেই তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাচ্চা নিতে বাধ্য করা উচিত না… গর্ভপাত আমাদের অধিকার। আমরা এর জন্য লড়ে যাওয়া বন্ধ করব না।”

‘রো বনাম ওয়েড’ কি?

১৯৬৯ সালে ২৫ বছরের নরমা ম্যাককরভি নামের এক নারী, যার ছদ্মনাম ছিল ‘জ্যান রো’, টেক্সাসে গর্ভপাত নিষিদ্ধ আইনের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন।

টেক্সাসে তখন গর্ভপাত অসাংবিধানিক বলে নিষিদ্ধ ছিল। কেবলমাত্র মায়ের জীবন বাঁচানোর জন্য জরুরি হলে গর্ভপাতের অনুমোদন ছিল।

গর্ভপাত নিষিদ্ধ আইনের পক্ষে সে সময় লড়েছিলেন ডালাস কাউন্টির জেলা এটর্নি হেনরি ওয়েড। সেই থেকেই রো এর মামলাটির নাম হয় ‘রো বনাম ওয়েড’।

রো তার তৃতীয় সন্তান হওয়ার সময় গর্ভপাতের অধিকার চেয়ে ওই মামলা করেছিলেন। তার দাবি ছিল, তিনি ধর্ষিত হয়েছেন। কিন্তু সেই মামলা প্রত্যাখ্যাত হয় এবং রো সন্তান জন্ম দিতে বাধ্য হন।

১৯৭৩ সালে রো যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টে আপীল করেন। সেখানে তার মামলার সঙ্গে ২০ বছর বয়সী এক জর্জিয়ান নারীর মামলারও শুনানি হয়।

তারা যুক্তি দেখিয়ে বলেছিলেন, টেক্সাসের গর্ভপাত আইন ‍যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান পরিপন্থি। কারণ, এতে একজন নারীর ব্যক্তিগত অধিকারে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে।

আদালতের বিচারপতিরা তখন ঐতিহাসিক রায় দিয়ে বলেছিল, সরকারের গর্ভপাত নিষিদ্ধ করার মতো যথেষ্ট ক্ষমতা নেই। আর একজন নারীর গর্ভাতের অধিকার সংবিধানে সুরক্ষিত আছে।

আদালতের ওই সিদ্ধান্তের ফলে গর্ভধারণের পর থেকে ত্রৈমাসিক হিসাবে নারীদের গর্ভপাতের ওপর কড়াকড়ি আরোপ এবং তা নিষিদ্ধের ব্যবস্থা চালু হয়।

এই ‘ত্রৈমাসিক’ ব্যবস্থা হচ্ছে:

 * গর্ভধারণের প্রথম তিনমাসে যুক্তরাষ্ট্রে নারীদের গর্ভপাতের অধিকার পুরোপুরিভাবে থাকা।

* পরের তিনমাসে গর্ভপাত করাতে গেলে সরকারি কিছু নিয়মবিধির আওতায় পড়া।

* আর শেষ তিনমাসে ভ্রুণ আরও পরিণত অবস্থায় চলে যাওয়ার কারণে গর্ভপাতে কড়াকড়ি কিংবা নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়া।

তাছাড়া, ১৯৭৩ সালের এই ‘রো বনাম ওয়েড’ আইনি সিদ্ধান্তের বদৌলতে নারীরা গর্ভধারণের শেষ তিনমাসে গর্ভপাতের ওপর কোনওরকম নিষেধাজ্ঞা থাকলেও জীবন বাঁচাতে কিংবা স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রয়োজনে চিকিৎসকের অনুমতিসাপেক্ষে গর্ভপাত করানোর অধিকার পেয়েছে।

যেভাবে পাল্টানো হল রো রুলিং;

শুক্রবার সুপ্রিম কোর্ট মিসিসিপি রাজ্যের গর্ভপাত নিষিদ্ধ আইনের পক্ষে রায় দিয়েছে। মিসিসিপির আইনে গর্ভধারণের ১৫ সপ্তাহ পর গর্ভপাত নিষিদ্ধ।

মিসিসিপি’র এই আইন ‘রো বনাম ওয়েড’ রুলিং এবং ১৯৯২ সালের আরেক মামলার রায়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক আখ্যা দিয়ে ২০১৮ সালে আদালতে গিয়েছিল নারী স্বাস্থ্য সংগঠন জ্যাকসন।

দুটো ফেডারেল আদালত ওই দুই রায়ের সঙ্গে সহমত হয়েছিল এবং মিসিসিপি পরে জ্যাকসনের মামলাটি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে যায়। ২০২১ সালে মিসিসিপি’র মামলার শুনানি করতে রাজি হয় সুপ্রিম কোর্ট।

মিসিসিপির পক্ষ থেকে তখন আদালতকে রো রুলিংসহ ১৯৯২ সালের রুলিংও বাতিল করে দেওয়ার আবেদন জানানো হয়েছিল। পরে আদালতের ৬ রক্ষণশীল বিচারপতি মিসিসিপির গর্ভপাত নিষিদ্ধ আইনের পক্ষে ভোট দেন। বিপক্ষে পড়ে ৩ ভোট।

আর রো রুলিংকে বিলুপ্ত করার বাড়তি পদক্ষেপ না নিয়ে সেটি পাল্টে ফেলা বা বাদ দেওয়ার পক্ষে ভোট দেন ৫ বিচারপতি। বিপক্ষে পড়ে ৪ ভোট।

রায়ে বিচারপতিদের পক্ষ থেকে বিচারপতি স্যামুয়েল আলিটো লেখেন, ১৯৭৩ সালের রো রুলিংয়ে গর্ভধারণের পর ২৪ থেকে ২৮ সপ্তাহ সময়কালেও গর্ভপাত করার এখতিয়ার রাখা হয়েছে। এটি ভুল সিদ্ধান্ত। কারণ, মার্কিন সংবিধানে গর্ভপাতের অধিকারের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু বলা নেই।

‘রো বনাম ওয়েড’ রুলিং ‘বাতিল হওয়া আবশ্যক’ বলেও লেখা হয় রায়ে। রক্ষণশীল-সংখ্যাগরিষ্ঠ সুপ্রিম কোর্ট এমন রায় দেওয়ায় এখন গর্ভপাত করতে দেওয়া হবে কিনা সে সিদ্ধান্ত নেয়ার ভার চলে গেল রাজ্যগুলোর ওপর।

অর্থাৎ, সুপ্রিম কোর্টের রায়ে রাজ্যগুলো এখন ১২ সপ্তাহের আগেই গর্ভপাত নিষিদ্ধের পদক্ষেপ নেওয়ার এখতিয়ার পেয়ে গেল। যদিও এ রায়ের ফলে যুক্তরাষ্ট্রে এখনও গর্ভপাত আপনা থেকেই অবৈধ বলে গণ্য হবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *