উনিশ শতকে মানুষের আয়ুষ্কাল বেড়েছে দ্বিগুণ

ফিচার স্পেশাল

সেপ্টেম্বর ৫, ২০২২ ৭:০৬ পূর্বাহ্ণ

একশ বছর আগে সারা পৃথিবীর মানুষের গড় আয়ু ছিল মাত্র ৩২ বছর। এখন সেটা বেড়ে হয়েছে ৭৩ বছর। দেশ এবং জাতি ভেদে দশ বছর কম অথবা বেশি হতে পারে। মোদ্দা কথা হলো, গত ১০০ বছরে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। প্রশ্ন হলো, এটি কিভাবে সম্ভব হয়েছে? এর একটি প্রধান কারণ হচ্ছে, পৃথিবীতে শিশু মৃত্যুর হার এখন অনেক কমে গেছে। ১৯০০ সালে প্রতি এক হাজার শিশুর মধ্যে ১৬৫ জন শিশু এক বছর হওয়ার আগেই মৃত্যুবরণ করতো। ২০০০ সালে এই সংখ্যাটি মাত্র ৭ জনে নেমে এসেছে।

মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের ব্যাপারে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, কম সন্তান হওয়া, টিকাদান কর্মসূচির বিস্তৃতি, সুপেয় পানির ব্যবহার ইত্যাদি নানাবিধ কারণে শিশু মৃত্যুর হার এখন অনেক কমে গেছে। নিঃসন্দেহে মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এটি একটি বিশাল ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে।

কিন্তু মানুষের গড় আয়ু বাড়ার পেছনে এটি একমাত্র কারণ নয়। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো, গত ১০০ বছরের মানুষের জীবন যাত্রার মান অনেক উন্নত হয়েছে। মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বেড়েছে। সর্বোপরি চিকিৎসা ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে। আগে যেসব সংক্রামক রোগে মানুষের খুব সহজেই মৃত্যু হতো, অ্যান্টিবায়োটিক অথবা ভ্যাকসিন প্রয়োগ করে সেসব রোগ নিরাময় করা সম্ভব হয়েছে। নিউমোনিয়া, যক্ষ্মা, পোলিও, গুটিবসন্ত  ইত্যাদি রোগে মানুষের মৃত্যুর হার এখন নগণ্য।

অন্যান্য অনেক রোগের ক্ষেত্রেও চিকিৎসা সেবা প্রদান করে মৃত্যুর হার অনেক কমিয়ে আনা হয়েছে। যেমন ধরুন, আমাদের দেশে একসময় কলেরায় হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হতো, এখন সেটি আর হয় না। ম্যালেরিয়ার এবং টাইফয়েডের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

এছাড়া হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস’সহ বিভিন্ন ক্ষতিকর রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রেও চিকিৎসা শাস্ত্রে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে।  ক্যান্সারের চিকিৎসায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। উন্নত জীবন ব্যবস্থা,আধুনিক চিকিৎসা, পুষ্টিকর খাদ্য, ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে গত ১০০ বছরে মানুষের গড় আয়ু দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। বলাই বাহুল্য, ভবিষ্যতে এটি আরো বাড়বে।

ছবি: প্রতীকী

ছবি: প্রতীকী

এখন প্রশ্ন হলো, মানুষের আয়ুষ্কাল কতটা বাড়ানো সম্ভব? আমরা জানি, পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষ আছেন যারা ১০০ বছর বা তার চেয়েও বেশি বাঁচেন। জাপানে শতবর্ষী মানুষের সংখ্যা ৮৬ হাজারের বেশি। সাম্প্রতিক কালে ফ্রান্সের এক ভদ্র মহিলা ১২২ বছর বেঁচে ছিলেন বলে রেকর্ড আছে। কিন্তু পৃথিবীর ৭ বিলিয়ন জনসংখ্যার তুলনায় শতবর্ষী মানুষের সংখ্যা খুবই কম, সামগ্রিক জনসংখ্যার মাত্র ০.০০৪%। পৃথিবীর খুব কম সংখ্যক মানুষই তাদের শততম জন্মদিন পালন করতে পারেন।

আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হলো, গত একশো বছরে মানুষের গড় আয়ু দ্বিগুণ হলেও, বার্ধক্যকে মানুষ এখনো জয় করতে পারেনি। বার্ধক্যকে উপেক্ষা করে কত বছর মানুষ সুস্থ দেহে বেঁচে থাকতে পারে? এটি একটি বিশাল প্রশ্ন। আমরা সবাই জানি, বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের শরীর ভঙ্গুর হয়ে যায়।

বৃদ্ধ বয়সে এসে মানুষের অস্থি হয় দুর্বল, মাংসপেশি হয় শিথিল, ত্বক হয় অমসৃণ, চোখের দৃষ্টি হয় ঘোলাটে, স্মৃতিশক্তি কমে যায়। শরীর হয়ে ওঠে নানা রোগের বাসা। তারপর একসময় মানুষের শরীর এই ধকল আর নিতে পারে না। ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে মানুষ। একে বলা হয়, বার্ধক্য জনিত মৃত্যু। এটাকেই জীবনের স্বাভাবিক শেষ পরিণতি হিসেবে আমরা মেনে নিয়েছি।

কিন্তু বিজ্ঞানীরা মনে করেন, বার্ধক্যই মানুষের জীবনের শেষ পরিণতি হতে পারে না। তাঁরা বার্ধক্য নিয়ে গবেষণা করে বুঝতে পেরেছেন, বার্ধক্য আসলে একটি রোগ এবং এই রোগের নিরাময় করা সম্ভব। বার্ধক্যের কারণ নিহিত রয়েছে জীবকোষের অভ্যন্তরে।‌  বিজ্ঞানীরা বার্ধক্যের বেশ কয়েকটি জৈবিক কারণ চিহ্নিত করেছেন। বিজ্ঞানীরা বলছেন, সময়ের সাথে সাথে জীবকোষের ভেতরে বেশ কিছু জেনেটিক এবং এপিজেনেটিক পরিবর্তন ঘটে।  এই পরিবর্তন গুলোই সামগ্রিকভাবে বার্ধক্যের জন্য দায়ী। এসব পরিবর্তনের কিছুটা ঘটে ডিএনএর ভেতর, আর কিছুটা ঘটে ডিএনএর বাইরে। এগুলো হলো-

১. ক্ষতিগ্রস্ত ডিএনএ
২. টেলোমিয়ারের ক্ষয়
৩. হিস্টোনের পরিবর্তন
৪. মাইটোকনড্রিয়ার ত্রুটি
৫. প্রোটিনের অবক্ষয়
৬. নিয়ন্ত্রণহীন মেটাবলিজম
৭. প্রদাহ সৃষ্টিকারী অণুর বৃদ্ধি
৮. ক্ষয়প্রাপ্ত স্টেম সেল

বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন মডেল উদ্ভিদ এবং প্রাণী নিয়ে এ ব্যাপারে গবেষণা করেছেন। তাঁরা দেখেছেন, উপরোক্ত কারণগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে এসব প্রাণী এবং উদ্ভিদের আয়ুষ্কাল কয়েকগুন বৃদ্ধি করা সম্ভব।‌ এ নিয়ে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর বিভিন্ন গবেষণাগারে ব্যাপক গবেষণা চলছে। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হচ্ছে এসব গবেষণায়। একে বলা হয় এইজিং রিসার্চ। এ ব্যাপারে সাম্প্রতিককালে প্রচুর গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে।

ছবি: প্রতীকী

ছবি: প্রতীকী

গতবছর এ বিষয়ে তথ্যনির্ভর একটি বই প্রকাশ করেছেন, হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের অধ্যাপক ডক্টর ডেভিড সিনক্লেয়ার। বইটির নাম, ‘লাইফ স্প্যান’। অধ্যাপক সিনক্লেয়ার দীর্ঘদিন বার্ধক্য নিয়ে গবেষণা করছেন। দীর্ঘদিনের গবেষণা লব্ধ অভিজ্ঞতা দিয়ে সহজবোধ্য ভাষায় সাধারণ মানুষের জন্য তিনি বইটি লিখেছেন। বইটি নিউইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলারের তালিকায় স্থান পেয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে এ ব্যাপারে জনমানুষের প্রবল আগ্রহ রয়েছে।

প্রফেসর সিনক্লেয়ার বলেছেন, বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের ডিএনএতে কিছু ভাঙ্গন দেখা যায়, ফলে মানব জিনোম অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। এর প্রভাব ডিএনএর বাইরে এপিজিনোমেও পড়ে এবং জিন রেগুলেশন বাধাগ্রস্ত হয়। এর ফলে জীবকোষ তার স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলে এবং ক্রমান্বয়ে নিস্তেজ হয়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। তিনি মনে করেন, বার্ধক্যের ক্ষেত্রে এপিজিনোমের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এপিজিনোমের তথ্য পরিবর্তনের ফলে অনেক জিনের অভিব্যক্তি ঠিকমতো প্রকাশিত হতে পারে না এবং ডিএনএ মেরামত প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। এর ফলে জীবকোষ জরাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

তিনি মনে করেন, এই প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত বা বিপরীতমুখী করতে পারলে বার্ধক্যকে জয় করা সম্ভব। তিনি এব্যাপারে ইঁদুরের উপর গবেষণা করে বেশ সাফল্য অর্জন করেছেন। তিনি বেশকিছু জিন শনাক্ত করেছেন যার মাধ্যমে বার্ধক্যের প্রক্রিয়াকে শ্লথ করা দেয়া সম্ভব।

তিনি মনে করেন মানুষের ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য। এ নিয়ে এখন জোর গবেষণা চলছে। এ সম্বন্ধে বিস্তারিত বিবরণ ‘লাইফ স্প্যান’ বইটিতে  আছে। ‌এ ব্যাপারে আগ্রহী হলে বইটি পড়ে দেখতে পারেন। অ্যামাজনে বইটি পাবেন।

বর্তমান যুগের বিজ্ঞানীরা মনে করেন, মানুষের পক্ষে বার্ধক্যকে উপেক্ষা করে সুস্থ দেহে দেড়শো বছর বেঁচে থাকাটা খুবই সম্ভব। এর বেশি বাঁচাটাও অসম্ভব কিছু নয়। আজ যে শিশুটির জন্ম হয়েছে সেই হয়তো সুস্থ দেহে বেঁচে থাকবে দেড়শো অথবা দুশো বছর। আর এটি ঘটবে আগামী শতাব্দীর মধ্যেই। অনেকের কাছে একে কল্পনা মনে হতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, কল্পনাকেই বাস্তবে রূপান্তরিত করে বিজ্ঞান। যুগে যুগে সেটাই হয়ে এসেছে। বিজ্ঞানের জয়রথে চড়ে কল্পনার পরিধিকে ছাড়িয়ে অনেক অনেক দূরে এগিয়ে যাবে আগামীর মানুষ, এই আশা করাই যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *