ইউনিয়ন ভূমি প্রশাসন : আপিল তামাদি হওয়ায় ২ হাজার নিয়োগ বন্ধ

জাতীয়

সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২২ ১১:১২ পূর্বাহ্ণ

সময়মতো আপিল না করায় ইউনিয়ন ভূমি অফিসের প্রায় ২ হাজার পদে নিয়োগ বন্ধ হয়ে গেছে। নতুন করে নিয়োগবিধি প্রণয়নসহ নানা জটিলতায় ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তা (সহকারী তহশিলদার) পদে ১৮ বছর নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। এ কারণে অনুমোদিত পদের অর্ধেকই এখন শূন্য। অপরদিকে ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তার (তহশিলদার) ১৪শ পদও খালি। সহকারী তহশিলদার থেকে পদোন্নতি দিয়ে এই পদ পূরণ করতে হবে বলে সেটিও আটকে আছে।

এর ফলে ভূমি মন্ত্রণালয় ডিজিটাল সেবায় অনেক এগিয়ে গেলেও মাঠপর্যায়ের সেবা বিঘ্নিত হচ্ছে। যারা কর্মরত আছেন, তাদের মধ্যে অনেকে বয়স্ক এবং আইটিতে অদক্ষ। এটিই বড় বাধা। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, সংকট নিরসনে সহকারী তহশিলদার পদে দ্রুত দক্ষ লোক নিয়োগ দেওয়া জরুরি।

এদিকে সময়মতো আপিল না করায় ব্যাখ্যা চেয়ে সংশ্লিষ্ট প্যানেল আইনজীবীকে সোমবার শোকজ করা হয়েছে। এছাড়া এর সঙ্গে আরও যাদের গাফিলতির প্রমাণ মিলবে, তাদের বিরুদ্ধেও বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সূত্র জানায়, ভূমি সহকারী কর্মকর্তা ও ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তা নিয়োগ বিধিমালা-২০২১ এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন মাঠপর্যায়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ বিধিমালা-২০২১ নামে পৃথক দুটি বিধিমালা চূড়ান্ত করা হয় গত বছর ১৭ আগস্ট। কিন্তু ইউনিয়ন ভূমি অফিস ও এসি ল্যান্ড অফিসের পিয়ন বা অফিস সহায়ক, প্রসেস সার্ভার, চেইনম্যান, মোহরাররা সংক্ষুব্ধ হয়ে প্রস্তাবিত নিয়োগবিধিকে চ্যালেঞ্জ করে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে মামলা দয়ের করেন। মামলা নং ১৮৭/২০২০। তাদের অভিযোগ ছিল-সহকারী তহশিলদার পদে তাদের প্রাপ্য ২০ শতাংশ পদোন্নতির সুযোগ নিয়োগবিধিতে রাখা হয়নি। এ সংক্রান্ত ১৯৮৪ সালের নিয়োগবিধি (সংশোধিত-২০০১) অনুযায়ী সহকারী তহশিলদার পদের ২০ শতাংশ পদ উল্লিখিত পদগুলো থেকে পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করা হতো। তবে নতুন নিয়োগবিধিতে এ সুযোগ রাখা হয়নি। নতুন নিয়োগবিধিতে তাদেরকে অফিস সহকারী পদে পদোন্নতি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তারা সেটি মানতে নারাজ।

এদিকে নিয়োগবিধি চ্যালেঞ্জ করে মামলা করে ভুক্তভোগীদের দুটি গ্রুপ। ২৬ জেলার ১৫২ জনের পক্ষে মামলা করেন আজিজুল হক গং। এছাড়া ১১ জেলার ৬২ জনও একই দিনে প্রশাসনিক ট্রাইবুনালে মামলা করেন, যার নম্বর ১৮৬/২০২০। আজিজুল হক গং-এর মামলার শুনানি শেষে রায় হয় ৯ মার্চ। এরপর এর বিরুদ্ধে আপিল করার সময়সীমা ছিল ৩ মাস। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে ভূমি মন্ত্রণালয়ের পক্ষে কেউ আপিল করেনি। আপিলের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর বিলম্বিত আপিল করা হয়। যার নম্বর ২৪৬/২০২২। কিন্তু যথাসময়ে আপিল না করায় এ আপিল গ্রহণ করেননি আদালত।

প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল-১-এর রায়ে আবেদনকারীদের ২০০১ সালের নিয়োগবিধি অনুযায়ী ইউনিয়ন ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তা পদে পদোন্নতি দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়। এর ফলে আদালতের আদেশে নতুন নিয়োগবিধির কার্যকারিতা স্থগিত রয়েছে। এছাড়া নতুন নিয়োগবিধি কেন অবৈধ হবে না মর্মে হাইকোর্টে থাকা এ সংক্রান্ত আরও পৃথক ৫টি রিট মামলায় রুল দেওয়া আছে।

মোদ্দা কথা, আদালতের রুল ও রায়ের কারণে সহকারী তহশিলদার পদে নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। এক বছর আগে নিয়োগবিধি চূড়ান্ত হলেও ভূমি মন্ত্রণালয় নিয়োগের কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি।

এ প্রসঙ্গে ভূমি মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, কেন সময়মতো আপিল করা হয়নি, সে বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে আজই (সোমবার) সংশ্লিষ্ট প্যানেল আইনজীবীকে শোকজ করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানো হয়েছে সলিসিটরের দপ্তরে। তিনি বলেন, ২০১০ সালের ২৬ আগস্ট উচ্চ আদালতের এক রায়ে সামরিক শাসনামলের সব সামরিক আদেশ, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের আদেশ, আইন ও বিধিবিধান অবৈধ ঘোষণা করা হয়। এ কারণে ১৯৮৪ সালে প্রণীত ভূমি মন্ত্রণালয়ের এ সংক্রান্ত আইনও বাতিল হয়ে যায়। এর ফলে নতুন করে আইন ও নিয়োগবিধি করতে হয়েছে। আগের বিধিতে ফিরে যাওয়ার আইনগত কোনো সুযোগ নেই। এ বিষয়টি যথাযথভাবে এবং যথাসময়ে আদালতের নজরে না আনায় এ সংকট তৈরি হয়েছে। তবে আশার কথা হলো, অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস এ বিষয়ে খুবই আন্তরিক। বিশেষ করে অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ আমিন উদ্দিন ব্যক্তিগতভাবে সরকারের পক্ষে কার্যকর ভূমিকা রাখবেন আশ্বাস দিয়েছেন।

ভূমি মন্ত্রণালয়ের পক্ষে এ মামলার প্যানেল আইনজীবী আবুবক্কর চৌধুরী সোমবার বলেন, ‘এখানে আমার কোনো গাফিলতি নেই। রায় হওয়ার পর সবকিছু সলিসিটর উইং এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে মোবাইল ফোনে বিস্তারিত জানিয়েছি। কিন্তু কেউ কোনো যোগাযোগ করেননি। তাহলে আমার কী করার আছে?’। তিনি বলেন, ‘এ সংক্রান্ত আরেকটি মামলায় সরকার পক্ষ হেরে গেছে। সেটিও জানিয়েছি। কিন্তু ওই ব্যাপারেও তারা নিশ্চুপ।’

প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়েরকারী আজিজুল গং-এর প্রধান কিশোরগঞ্জ সদরের রাশিদাবাদ ইউনিয়ন ভূমি অফিসের অফিস সহায়ক আজিজুল হক জানান, ২০১৩ সাল পর্যন্ত আগের নিয়োগবিধিতে তাদের পদোন্নতি হয়েছে। তার আগের সিরিয়ালের কর্মচারীও পদোন্নতি পেয়েছেন। কিন্তু তার সিরিয়াল আসার পর আর দেওয়া হয়নি। তিনি মনে করেন, তাদের দাবি যৌক্তিক। আদালতের রায় অনুযায়ী তাদের পদোন্নতি দেওয়া উচিত।

এ প্রসঙ্গে ভূমি মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, শিগগিরই লিভ টু আপিল করা হবে। বাস্তব অবস্থা এবং সব যুক্তি ও তথ্য উপস্থাপন করে ভূমি মন্ত্রণালয় আদালতে শক্ত আইনি লড়াই চালিয়ে যাবে। তিনি বলেন, এমনিতে অদক্ষ ও বয়স্ক জনবল দিয়ে গতিশীল ভূমি মন্ত্রণালয়ের ডিজিটাল ভূমিসেবা ইউনিয়ন পর্যায়ে সেভাবে পৌঁছানো যাচ্ছে না। তাই আগের নিয়োগবিধিতে ফিরে যাওয়া সম্ভব হবে না। জনগণের দোরগোড়ায় যথাযথভাবে ডিজিটাল ভূমিসেবা পৌঁছে দিতে হলে এ ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তিনি জানান, ভূমি অফিসগুলোয় এখনো ঘুস, দুর্নীতি ও জনহয়রানি যেসব অভিযোগ পাওয়া যায়, এর সঙ্গে একটি চক্র জড়িত। যারা বাইরের কেউ নন। তারা ঘুস কালেক্টর হিসাবে পরিচিত। ভূমি মন্ত্রণালয় এখন এ চক্রের প্রত্যেককে চিহ্নিত করে শক্ত ব্যবস্থা নেবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *