আত্মহত্যা করেননি ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ, হত্যা করা হয়েছিল তাকে!

ফিচার

জুন ১৮, ২০২২ ১১:৫৯ পূর্বাহ্ণ

১৮৯০ সালের ২৯ জুলাই। প্যারিস থেকে কয়েক মাইল দূরের ছোট্ট বসতি ওভের-সুর-ওয়াজ। সেখানে এক চিলেকোঠার ঘরেই থেমে গেল হৃদস্পন্দন। রাত ১টা নাগাদ, ২৯ ঘণ্টার অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেলেন মাত্র ৩৭ বছর বয়সের বিখ্যাত চিত্রকার ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ।

ছোট্ট এক শিল্পী জীবন। কারণ ছোট থেকে কখনোই তুলি ধরেননি ভ্যান গঘ। ২৭ বছর বয়সে ঘরছাড়া হয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন আঁকার কাছে। হাতে নিয়েছিলেন রং-তুলি-ইজেল আর ক্যানভাস। মাত্র ১০ বছরের ছোট্ট সময়েই প্রায় দুই হাজার ১০০ ছবি এঁকেছেন ভ্যান গঘ। যার মধ্যে অধিকাংশ জীবনের শেষ দু-তিন বছরে। এরপরেই মৃত্যু। ভিনসেন্টের সেই আত্মহত্যার ঘটনা সবারই পরিচিত। তবে মৃত্যু না মিথ, তা আজও স্পষ্ট নয়। সত্যিই কি আত্মহত্যা করেছিলেন ভিনসেন্ট? নাকি হত্যা করা হয়েছিল তাকে?

এই বিতর্কে যাওয়ার আগে বেশ কিছু কথা বলতে হয় ভ্যান গঘের সম্পর্কে। প্রথমত, ছোটো থেকেই বাকি ভাই-বোনদের মতো ছিলেন না ভিনসেন্ট। একাকিত্ব ছিল তার সব সময়ের সঙ্গী। ছোটো থেকেই একের পর এক ঘটনায় তার ভেতরে বাসা বেঁধেছিল ডিপ্রেশন। কোনো সিদ্ধান্তে মনস্থির করতে পারতেন না ভিনসেন্ট। আর যার জেরে বারবার উপার্জনের ঠিকানা বদলাতে হয়েছে তাকে। অদ্ভুত আচরণের জন্য পড়তে হয়েছে মানুষের রোষে, শিকার হতে হয়েছে পীড়নের। আধুনিক মনোবিদদের অনেকের মতেই তিনি স্ক্রিৎজোফ্রেনিয়া, সিফিলিস, হাইপার-গ্রাফিয়া, ম্যানিক-ডিপ্রেশন, টেম্পোরাল লোব এপিলেপ্সির মতো মানসিক রোগে আক্রান্ত ছিলেন।

একরোখা, জেদি ভিনসেন্টের সঙ্গে তাই সেভাবে অন্তরঙ্গতা তৈরি হয়নি কারোরই।

ভিনসেন্ট জানতেন, শুধু ছবি আঁকাই তাকে খুশি রাখতে পারে। সতেজ রাখতে পারে। তবে বুনো হিংস্র রাগটা নিজের ওপরেই ফিরে এসেছিল আবার।

দিনটা ছিল ২৭ জুলাই। লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিলেন চিলেকোঠার ছোট্ট ঘরটা। নিজের স্টুডিও। তারপর সেই সরাইখানা থেকে বেরিয়ে যেতে দেখা গিয়েছিল তাকে। গমক্ষেতের পাশের রাস্তা ধরে মিলিয়ে গিয়েছিলেন ভিনসেন্ট। খানিক বাদে আকাশ ফাটানো একটা শব্দে সম্বিত ফিরে ছিল সবার। বুকে হাত চেপে ছুটতে ছুটতে নিজের ঘরে চলে এসেছিলেন ভিনসেন্ট। পাঁজরের ধার ঘেঁষে রক্তের ধারা। অসহ্য এক যন্ত্রণা।

তারপর সেই অভিশপ্ত ২৯ ঘণ্টা। প্যারিস থেকে ছুটে এসেছিলেন তার ভাই থিও। চিকিৎসক এসেছিলেন। কিন্তু সফল হয়নি প্রাণ ফিরিয়ে দিতে। শুধু ভাই থিও এর হাতে হাত রেখে বসে ছিলেন শেষ মুহূর্ত অবধি। বারবার জিজ্ঞেস করার পরেও ভাই থিওকে বলেছিলেন আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছেন তিনি। কারণ জিজ্ঞেস করায় বলেছিলেন, ‘আমার দেহ, আমি যা ইচ্ছা করতে পারি’। তাহলে বিতর্ক কীসের?

কিছুদিন আগে, গবেষক গ্রেগরি হোয়াইট স্মিথ এবং স্টিভেন নাইফে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি মত পেশ করেছেন ভ্যান গঘের মৃত্যু প্রসঙ্গে। প্রমাণ দিয়েছিলেন এই ঘটনার। এই ঘটনা আগেও অনেকের গবেষণায় উল্লেখিত হয়েছিল। ভিনসেন্ট যে দীর্ঘদিন ধরেই খরচের ব্যাপারে চিন্তিত ছিলেন তাতে আশ্চর্যের কিছুই নেই। কারণ থিও, যে ভাই তার সমস্ত আঁকার খরচ বহন করতেন, তার আর্থিক অবস্থা তখন বেশ খারাপের দিকে। অন্যদিকে বাড়ছিল ভিনসেন্টের নিজের খরচও। পাশাপাশি সংসারী হয়েছেন থিও। ঘরে এসেছে সদ্যোজাত শিশু। এসবের মধ্যেই ভিনসেন্টের আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক নয়। কিন্তু আত্মহনন করতে হলে তিনি নিজের স্টুডিওতেই করতে পারতেন। মদ্যপ অবস্থায় গমক্ষেতের দিকে তার চলে যাওয়া কেন? দ্বিতীয়ত, যদি আত্মহত্যাই করা তার উদ্দেশ্য ছিল, তবে গুলি চালানোর পরে তিনি আবার ফিরে এলেন কেন সরাইখানায়? নিজেকে শেষ করার উদ্দেশ্য থাকলে কি দ্বিতীয় গুলি তিনি চালাতেন না?

এমনই প্রশ্ন সামনে দাঁড় করিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন দুই গবেষক। সেখানেই এক নতুন চরিত্রের সন্ধান পান তিনি। রেনেয়া সেক্রেটান। ভ্যান গঘের কান এবং তার পাগলামি প্রায়শই ছিল যার ঠাট্টার উপাদান। তার বাবা ছিলেন প্যারিসের প্রভাবশালী এক ব্যক্তি। বাবার থেকেই জোগাড় করেছিলেন একটি বাতিল পিস্তল। কারণ নিজেকে ‘কাউবয়’ হিসেবে দেখতে পছন্দ করতেন রেনেয়া। এমনকি জুতো, টুপি পরে কাউবয় সেজেই ঘুরে বেড়াতেন তিনি সুর-ওয়াজে।

ভ্যান গঘ। ছবি: সংগৃহীত

ভ্যান গঘ। ছবি: সংগৃহীত

নিজের জীবনের শেষ কিছু লেখায় বেশ কয়েকবার রেনেয়া লিখেছিলেন, ভিনসেন্টকে উত্যক্ত করতেন তিনি। সেই দৃশ্য ওয়েজের অন্যান্য গ্রামবাসীরাও প্রত্যক্ষ করেছেন। কিন্তু ভিনসেন্টের মৃত্যুতে তার ভূমিকা কী? কেবলমাত্র ভিনসেন্টের মৃত্যুতে ব্যবহৃত পিস্তলটি দিয়েছিলেন তিনি। উল্লেখ করেছিলেন, ‘যখন ব্যবহৃত হতে চেয়েছে, তখনই ঝলসে উঠেছিল এই পিস্তল’।

তবে পুলিশের কোনো তথ্যেই কোনো রেকর্ড নেই এই ঘটনার। হয়তো তার বাবা একজন প্রভাবশালী আর্মি কর্মকর্তা ছিল বলেই। মজা আর উত্যক্ত করার ছলেই কি সেদিন ট্রিগারে চাপ দিয়েছিল রেনেয়া? আর গুলি ছুটে গিয়েছিল ভিনসেন্টের পাঁজরের দিকে?

গমক্ষেতের কাছে এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন না কেউই। ভিনসেন্ট ফিরে আসার পর যারা সামনে থেকে দেখেছিলেন তাদের কথা ভিত্তিতেই রিপোর্ট নেওয়া হয়েছিল ভিনসেন্টের মৃত্যুর। জানা যায় ভিনসেন্টের যেখানে গুলি লেগেছিল সেই ক্ষতস্থানের চারিদিকে দুটি বৃত্তাকার দাগ দেখা গিয়েছিল। একটি কালচে বেগুনি এবং অন্যটি বাদামি। তার ভিত্তিতেই অনেক ঐতিহাসিকরা লিখেছিলেন বুকে ঠেকিয়েই গুলি চালিয়েছিলেন ভিনসেন্ট। বুলেটের আঘাতে ওই বেগুনি বলয়ের সৃষ্টি হয়েছিল। এবং বাদামি বলয়টির জন্য দায়ী বারুদের জ্বলন।

গ্রেগরি হোয়াট আর স্টিভেন নাইফে এই বিষয়টির ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা পেতে ইয়র্কের ফরেনসিক এক্সপার্ট ডঃ ডি মায়োর কাছে দ্বারস্থ হয়েছিলেন ২০১২ সালে। ডি মায়ো বর্ণনা শুনে উদাহরণও দেখিয়ে ছিলেন। বলেছিলেন, বুলেটের জন্য দেহে কোনো শিরা ছিঁড়ে গেলে এমন ঘটনা ঘটে। বুলেটবিদ্ধ হওয়ার পরও যারা দীর্ঘক্ষণ বেঁচে থাকেন। তাদের প্রায় সবার ক্ষেত্রেই এই উপসর্গ দেখা যায়। আর বাদামি সেই বলয়টিও অস্বাভাবিক কিছুই না।

অন্যদিকে অভিশপ্ত সেই বন্দুকের ব্যাপারে চাঞ্চল্যকর তথ্য দেন ডি মায়ো। ১৮৮৪ সালে প্রথম আবিষ্কৃত হয়েছিল ‘স্মোকলেস গানপাউডার’। ১৮৯০ সাল নাগাদ ফ্রান্সের সেনা বাহিনীর অধিকাংশের কাছেই আসেনি এই আধুনিক বারুদের বন্দুক। তার আগে অবধি বন্দুকে ব্যবহৃত হত ‘ব্ল্যাক পাউডার’ নামের একটি বারুদ। কাছ থেকে যদি সেই বারুদ ব্যবহৃত হয়ে থাকে, তবে ভিনসেন্টের দেহে একটি মাত্র ছিদ্র থাকার কথাই নয়। বরং তার আশেপাশের অংশও ঝলসে যাওয়ার কথা। কিন্তু এমন তথ্য উল্লেখ নেই কোথাও। ডি মায়ো মতামত দেন, অন্তত দেড় ফুটেরও বেশি দূরত্ব থেকে গুলি চলেছিল সেই বন্দুক থেকে। অর্থাৎ, ভ্যান গঘ নিজে চালাননি সেই বন্দুক।

২০১৩ সালে এই দুই গবেষক তাদের গবেষণাপত্র পাঠিয়েছিলেন ভ্যান গঘ মিউজিয়ামে। এক কিউরেটর সমস্ত তথ্যগত বিশ্লেষণ দেখে জানিয়েও ছিলেন, ‘ভিনসেন্টের মৃত্যু এভাবেই হয়তো হয়েছিল। আমরা উপযুক্ত প্রমাণ দিতে সক্ষম হইনি। তবে এই গবেষণা সত্যি হলেও বিশ্বাসযোগ্য না। কারণ, মানুষের মাথায় সেই বুলেটের মতই গেঁথে রয়েছে আত্মহত্যার মিথ।’

শিল্পী জীবনে হাঁটার আগে ভ্যান গঘ কাজ করতেন এক স্কুলে। দারিদ্রকে দেখেছেন সামনে থেকে। অনটনের শিকার হওয়া ছোট্ট কিশোর-কিশোরীদের কাছে সাধ্যমত সাহায্যের চেষ্টাও করেছেন। যার জন্য খোয়াতে হয়েছে চাকরিও। মৃত্যুর সময়ও কি বালক রেনেয়াকে সেভাবেই ‘বাঁচাতে’ চেয়েছিলেন ‘পাগল’ ভিনসেন্ট? জানা নেই। শুধু সেই মৃত্যু ঘিরেই আজও ঘুরে যাচ্ছে নক্ষত্রে নক্ষত্রে ভরা ওভের-সুর-ওয়াজের একটা রাত। আর হাওয়ায় মাথা দোলাচ্ছে একলা সাইপ্রেস।

আর ঘাতক সেই অস্ত্র? গত বছরেই সেই পিস্তলকে নিলামে তুলেছিল ভ্যান গঘ মিউজিয়াম। বিক্রি হয়েছিল প্রায় এক কোটি ২৭ লাখ টাকায়। মৃত্যুর বছরেই তার আঁকা ছবি ‘দ্য রেড ভাইনইয়ার্ড’ ৪০০ ফ্র্যাঙ্কে বিক্রি হওয়ায় খুশি হয়েছিলেন ভিনসেন্ট। ভাই থিওকে চিঠিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে লিখেছিলেন স্বপ্নের কথা। ‘আমি আশাবাদী প্যারিসের ছোট্ট এক কফিশপে একদিন আমার ছবির একক প্রদর্শনী হবে’।

ভিনসেন্ট বেঁচে থাকতে দাম পাননি তিনি কিংবা তার ছবি। জীবদ্দশায় বিন্দুমাত্র সম্মানও পাননি। অথচ তার মৃত্যুর পরে তার আঁকা ছবির দাম আজ কোটি টাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *