শেখ হাসিনা: এক মানবিক প্রধানমন্ত্রী

জাতীয় স্লাইড

সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২২ ৯:৫৯ পূর্বাহ্ণ

শেখ হাসিনা। গণতন্ত্রের এক অপ্রতিরোধ্য কণ্ঠস্বর। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা। গণতন্ত্রের এক বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে ছিয়াত্তরে পা দিলেন তিনি। দীর্ঘ এ যাত্রায় তিনি মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন বহুবার। মৃত্যুও আসে-যায়; কিন্তু শেখ হাসিনা অবিচল, কিরণদীপ্ত।

দেশ শাসনে দিয়েছেন দক্ষতা ও প্রজ্ঞার পরিচয়। বিশ্ব রাজনীতিতে তৈরি করেছেন নিজস্ব পরিচয়। আপন আলো ছড়িয়েছেন জগতময়। মানবিকতা দিয়ে কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে চিরভাস্বর তিনি। সফলতার সঙ্গে করোনা মহামারি মোকাবিলা করেন। আর রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে মানবিকতার অনন্য নজির স্থাপন করেন।

তার নেয়া পদক্ষেপ জাতিসংঘ, বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাময়িকী ফোর্বসসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে। শেখ হাসিনার উন্নয়ন কর্মসূচি উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এক রোল মডেল। যে কারণে তিনি একজন অনুসরণীয় বিশ্ব রাজনীতিক।

রাজনৈতিক জীবনে কারাভোগ করেছেন। ছিলেন গৃহবন্দি। রেকর্ডগড়া চারবারের এ প্রধানমন্ত্রী দল ও দেশকে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। দীর্ঘযাত্রার ক্লান্তিহীন এ যোদ্ধার কাঁধে এখনো অনেক দায়িত্ব। শেখ হাসিনার জন্ম ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় কেটেছে শৈশব-কৈশোর।

তার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। তখন প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন শেখ হাসিনা। এরপর ২০০৮ সালে দ্বিতীয়, ২০১৪ সালে তৃতীয় ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন তিনি।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মেয়ে, আমি শাসক নই, মানুষের সেবক। জনগণের সেবা ও কল্যাণ করাটাকেই আমি সব থেকে বড় কাজ বলে মনে করি। সেই ব্রত নিয়েই আমি কাজ করে যাচ্ছি।’

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শেখ হাসিনা তার সব কর্মকাণ্ডে বঙ্গবন্ধুকে অনুসরণ করছেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনাও সেটা অনুসরণ করছেন। বিশ্ব এ সংস্থার ৭৭তম সাধারণ অধিবেশনে এবারও বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলেছেন বাংলায়।

শৈশব ও লেখাপড়া
শৈশবের স্মৃতিচারণ করে শেখ হাসিনা বলেন, তখন তিনি গ্রামের রাস্তায় সমবয়সীদের সাথে ঘুরে বেড়াতেন, প্রায়ই কাঁচা কুল খুঁজতেন, যা ঐতিহ্যবাহী বাংলাদেশের একটি শিশুর আদর্শ জীবনযাত্রায়। তিনি কীভাবে মাছ ধরা জাল ‘ওচা’ দিয়ে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে মাছ ধরতেন তা স্মরণ করতে ভালোবাসেন।

কয়েক দশক পরে একদল বাচ্চার সঙ্গে আলাপের সময় শৈশবের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি গ্রামের বাড়িতে গাছে উঠা, খালে সাঁতার কাটা, মাছ ধরা এবং অন্যের গাছ থেকে কাঁচা আম পেড়ে খাওয়ার মত দুষ্টুমির কথা বলেন। তিনি বলেন, সেগুলো ছিল আমার জীবনের সেরা সময়।

প্রকৃতির সঙ্গে পরিচিতি, গ্রামের সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলামেশা, তার মধ্যে মানুষের পাশাপাশি পরিবেশের প্রতি ভালবাসা, সামাজিক বন্ধন এবং ঐতিহ্যগত বুদ্ধিমত্তা বা লোকায়ত জ্ঞান বোঝার দক্ষতা তৈরি করেছে। পারিবারিক মূল্যবোধের সঙ্গে এই বোধজ্ঞান এবং প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি ভালবাসা তার মূল চরিত্র গড়ে তুলেছে।

শেখ হাসিনা এসএসসি পাস করেন ঢাকার আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয় থেকে। এরপর ভর্তি হন তখনকার ইন্টারমিডিয়েট গভর্নমেন্ট গার্লস কলেজে (বর্তমান বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা মহাবিদ্যালয়)। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করেন।

১৯৬৭ সালের ১৭ নভেম্বর পরমাণুবিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে শেখ হাসিনা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে গৃহবন্দি থাকা অবস্থায় ১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই শেখ হাসিনার প্রথম সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয়ের জন্ম। ১৯৭২ সালের ৯ ডিসেম্বর জন্ম নেন তার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল।

শেখের বেটি
মানুষ ভালোবেসে তাকে ডাকেন শেখের বেটি বলে। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু পরিবারকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দিতে নির্মম হত্যাকাণ্ড চালানো হয়। সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তার স্নেহময়ী দুই কন্যা। এরপর একুশ বছর পর ক্ষমতায় আসেন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে মানুষের ভাগ্য বদলে দিতে তিনি বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছিলেন। স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা ও পুষ্টিসেবা দিতে তিনি গঠন করেন কমিউনিটি ক্লিনিক। মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতেই তিনি এমন উদ্যোগ নিয়েছিলেন। মাতৃমৃত্যুর হার বেশি এমন একটি দেশের জন্য তার এই ধারণা ছিল আশীর্বাদ। বাংলাদেশের পাশাপাশি বিশ্ববাসীও তাকে বিভিন্ন নাম ও উপনামে চেনে। কখনো তিনি পদ্মাকন্যা, কখনো তিনি মাদার অব হিউম্যানিটি। গেল ১৫ বছরের শাসনে তিনি বাংলাদেশকে আমূল বদলে দিয়েছেন। তার নেতৃত্বে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধের পথে এগিয়ে চলছে দেশ।

প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় বলেন, তার (শেখ হাসিনা) হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ, দেশের মানুষ দেখছে তাদের জীবনমান উন্নয়নের স্বপ্ন; তিনি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন মানুষের জন্য, করেছেন ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন।

গেল কয়েক দশকে রচিত হয়েছে শেখের বেটি গল্পটি। নিজের অক্লান্ত পরিশ্রম দিয়ে তিনি সেই প্রমাণ দিয়েছেন। রাজনৈতিক পরিবারে বেড়ে উঠলেও আশির দশকের আগে তেমনভাবে তিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন না। তিনি ছিলেন আর ১০ জন বাঙালি মেয়ের মতোই। সেই অবস্থা থেকে বেরিয়ে তিনি যদি আওয়ামী লীগের হাল না ধরতেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী না হতেন, তাহলে আজ এ উন্নতি, এ অগ্রগতি হতো না। বাংলাদেশের মানুষকে হয়তো তখন ভিন্ন চিত্র দেখতে হতো।

শেখ হাসিনা দেশ শাসন করছেন বলেই দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা ও যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়েছে। তিনি রাজনীতিতে না এলে স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী পালন করতে পারতো না।

নির্বাসনে শেখ হাসিনা
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বামী ড. ওয়াজেদ আর বোন শেখ রেহেনাকে নিয়ে ব্রাসেলসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের কাছে ছিলেন শেখ হাসিনা। তাদের প্যারিস যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আগের দিনই গাড়ির দরজায় হাত চাপা পড়েছিল ড. ওয়াজেদের। এ অবস্থায় প্যারিস যাওয়া ঠিক হবে না; তা আলোচনা করছিলেন তারা।

এক খবরে বলা হয়: ব্রাসেলসে তখন সকাল সাড়ে ৬টা। ফোন বেজে উঠল সানাউল হকের। অপর প্রান্তে জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন রশিদ চৌধুরী। তিনিই বললেন, বাংলাদেশে সেনা বিদ্রোহ হয়েছে সকালে। প্যারিসে না গিয়ে তাদের তখনই জার্মানি ফেরত যাওয়ার কথা বললেন তিনি।

কিন্তু সানাউল হক যখন শুনলেন বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছেন, তখনই তার দুই কন্যা ও জামাতাকে সাহায্য করতে অস্বীকার করলেন। নিজের ঘর থেকেও তাদের চলে যেতে বলেন তিনি। সেই কথা স্মরণ করে পরে এক অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা যেন তার জন্য বোঝা হয়ে গিয়েছিলাম। অথচ শেখ মুজিবই তাকে বেলজিয়ামে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত করে পাঠিয়েছিলেন। ওটা একটা রাজনৈতিক নিয়োগ ছিল। ওই খবর পাওয়ার পরে জার্মানি পর্যন্ত যাওয়ার জন্য একটা গাড়ি দিতেও অস্বীকার করেছিলেন তিনি।

তবে তারা কোনো মতে হুমায়ূন রশিদ চৌধুরীর কাছে পৌঁছান। পরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্ধিরা গান্ধী তাদের রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে রাজি হন। ২৪ আগস্ট এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমানে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে পৌঁছান শেখ হাসিনা।

ভারতের মন্ত্রিপরিষদের একজন যুগ্ম সচিব তাদের স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে ছিলেন। প্রথমে ৫৬ নম্বর রিং রোডের একটি সেফ হাউসে তাদের রাখা হয়। পরে ডিফেন্স কলোনির একটি বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়।

স্বদেশ প্রত্যাবর্তন
শেখ হাসিনা যখন স্বামীর সঙ্গে বিদেশে যান, তখন তার বাবা জীবিত, দেশের সরকারপ্রধান। কিন্তু যখন ফিরে আসেন, তখন পরিবারের কেউ বেঁচে নেই। বাবা, মা, ভাইসহ তার আত্মীয়দের হত্যা করা হয় নির্মমভাবে। এক গভীর ও বুকভরা শূন্যতা নিয়ে ১৯৮১ সালের ১৭ মে তিনি দেশে ফেরেন। এরপর আওয়ামী লীগের মতো একটি বড়ো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব নেন শেখ হাসিনা। তার এই ফিরে আসা দেশের পরবর্তী রাজনৈতিক আবহকে বদলে দিয়েছিল। রচিত হয়েছেন নতুন পটভূমি।

শিক্ষাজীবনে তিনি ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন। কলেজ ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতিও নির্বাচিত হন। কাছ থেকে বাবার রাজনৈতিক জীবন দেখেছেন নিবিড়ভাবে। জেল-জুলুম-অত্যাচার-মামলা থোড়াই কেয়ার করে দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে তিনি সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন। তাকে এক রাজনৈতিক দুর্গম ও পিচ্ছিল পথে হাঁটার সিদ্ধান্তই নিতে হয়েছে তখন।

১৯৮১ সালের ১৪-১৬ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে বাধ্যতামূলক নির্বাসনে থাকা শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। জিয়াউর রহমানের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তিনি দেশে ফিরেছিলেন। এরপর ইতিহাস গড়ার কারিগর হতে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে রাজনীতিতে নিয়োজিত করেন।

দীর্ঘ নির্বাসন শেষে তিনি যখন দেশে ফেরেন, তখন তাকে বরণ করতে নেমেছিল জনতার ঢল। তার এই প্রত্যাবর্তনের মধ্যদিয়ে মুক্তিযুদ্ধের হারানো চেতনাকে ফিরিয়ে রাজনৈতিক সম্ভাবনার নতুন বাঁক তৈরি করেছিল। ১৯৮১ সালের ১৮ মে দৈনিক ‘সংবাদ’ ‘লাখো জনতা অকৃপণ প্রাণঢালা অভ্যর্থনার মধ্যদিয়ে বরণ করে নেয় তাদের নেত্রীকে’ শিরোনামের এক খবরে লিখে: রাজধানী ঢাকা গতকাল (১৭ মে) মিছিলের শহরে পরিণত হয়েছিল। প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টিও মিছিলের গতিরোধ করতে পারেনি। স্লোগানেও ভাটা পড়েনি। লাখো কণ্ঠের স্লোগান নগরীকে প্রকম্পিত করেছে।

পত্রিকাটি আরও জানায়, বিকেল সাড়ে চারটায় আকাশে যখন শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমানটি দেখা যায় তখন সকল নিয়ন্ত্রণ আর অনুরোধ-আবেদন অগ্রাহ্য করে হাজার হাজার মানুষ বিমানবন্দরের ভেতরে ঢুকে যায়। অনেকটা ঝুঁকি নিয়েই বিমানটি অবতরণ করে। জনতা একেবারেই বিমানের কাছে চলে যায়। বহু চেষ্টার পর জনতার স্রোতকে কিছুটা সরিয়ে ট্রাকটি ককপিটের দরজার একেবারে সামনে নেয়া হয়। এই সময়ে শেখ হাসিনা ভেতর থেকে জনতার উদ্দেশে হাত নাড়েন।

বেলা ৪টা ৩২ মিনিটে শেখ হাসিনা কাঠের সিঁড়ি দিয়ে ট্রাকে নেমে আসেন। এই সময় লাখো জনতার কণ্ঠে ছিল গগন বিদারী স্লোগান- ‘হাসিনা তোমায় কথা দিলাম, মুজিব হত্যার বদলা নেব।’ এ সময় অনেকের চোখে ছিল অশ্রুধারা। প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাক যখন মালা পরিয়ে দেন তাকে, তখন শেখ হাসিনাও অঝোর ধারায় কান্না করছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা
তার শাসনামলে আর্থসামাজিক খাতে দেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে শেখ হাসিনা সরকারের উল্লেখযোগ্য সাফল্যগুলো ছিল: ভারতের সাথে ৩০ বছর মেয়াদী গঙ্গা নদীর পানি চুক্তি, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি, যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণ এবং খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন।
তিনি কৃষকদের জন্য বিভিন্ন কল্যাণমূলক কর্মসূচি এবং ভূমিহীন, দুস্থ মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি চালু করেন। যেমন—দুস্থ মহিলা ও বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, বয়স্কদের জন্য শান্তি নিবাস, আশ্রয়হীনদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প এবং একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প।

২০০৯-২০১৩ মেয়াদে শেখ হাসিনা সরকারের উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলোর মধ্যে রয়েছে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ১৩ হাজার ২৬০ মেগাওয়াটে উন্নীতকরণ, গড়ে ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন, ৫ কোটি মানুষকে মধ্যবিত্তে উন্নীতকরণ, ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সামুদ্রিক জলসীমা বিরোধের নিষ্পত্তি, প্রতিটি ইউনিয়নে ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন, মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীর মধ্যে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, কৃষকদের জন্য কৃষিকার্ড এবং ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলা, বিনা জামানতে বর্গাচাষিদের ঋণ প্রদান, চিকিৎসা সেবার জন্য সারা দেশে প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন, দারিদ্র্যের হার ২০০৬ সালের ৩৮ দশমিক ৪ থেকে ২০১৩-১৪ বছরে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশে হ্রাস, জাতিসংঘ কর্তৃক শেখ হাসিনার শান্তির মডেল গ্রহণ। এর বাইরেও অসংখ্য অর্জন রয়েছে তার।

২০১৪-২০১৮ মেয়াদে উল্লেখযোগ্য সাফল্যগুলোর মধ্যে রয়েছে: বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীতকরণ, ভারতের পার্লামেন্ট কর্তৃক স্থল সীমানা চুক্তির অনুমোদন এবং দুই দেশের তাতে অনুসমর্থন (এর ফলে দুই দেশের মধ্যে ৬৮ বছরের সীমানা বিরোধের অবসান হয়েছে), মাথাপিছু আয় এক হাজার ৬০২ মার্কিন ডলারে উন্নীতকরণ, দারিদ্র্যের হার ২২ দশমিক ৪ শতাংশে হ্রাস, ৩২ বিলিয়ন ডলারের ওপর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন শুরু, মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ।

চতুর্থ মেয়াদে এ পর্যন্ত অর্জিত উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলোর মধ্যে রয়েছে: বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়ন দেশের কাতারে অন্তর্ভুক্তিকরণ, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ সমাপ্ত এবং ঢাকায় মেট্রোরেলের পরীক্ষামূলক চলাচল শুরু, রাজধানী ঢাকার সঙ্গে বেশ কয়েকটি জেলা শহরের সংযোগ সড়ক চার-লেনে উন্নীত করা, রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ, মাতারবাড়ি বহুমুখী প্রকল্পসহ বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়নের কাজ দ্রুত এগিয়ে নেয়া। সারা দেশে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মিত হচ্ছে। সব বিভাগে আইসিটি পার্ক নির্মাণের কাজ চলছে। বর্তমানে মাথাপিছু আয় ২,৮২৪ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে।

শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা
বাসসের এক খবরে বলা হয়, বঙ্গবন্ধুকন্যা ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে যখন আওয়ামী লীগের হাল ধরেন, তখন থেকেই প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী তাকে হত্যা করতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হত্যা অপচেষ্টাগুলো হচ্ছে, ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর স্বৈরাচারবিরোধী অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে সচিবালয়ের সামনে তার গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। এ সময় আওয়ামী লীগ কর্মী নূর হোসেন মারা যান।

শেখ হাসিনাকে হামলার বড় চেষ্টা চালানো হয় পরের বছর ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি। তিনি জনসভা করতে চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন। চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে মিছিল করে জনসভাস্থলে যাওয়ার পথে মিছিলে হামলা হয়। তার গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। সেদিন প্রায় ১৪ নেতাকর্মী নিহত হন।

প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় ২০০০ সালের ২০ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় জনসভাস্থলের কাছে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রাখা হয়েছিল। এই বোমা গোয়েন্দাদের কাছে ধরা পড়ে। বোমাটি বিস্ফোরিত হলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত জনসভাস্থল।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে শান্তি সমাবেশস্থলে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এতে শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতা অল্পের জন্য এই ভয়াবহ হামলা থেকে বেঁচে গেলেও অপর ২৪ জন নিহত হন।

দায়মুক্তি অধ্যাদেশ বাতিল, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা
ইতিহাসের এক ঘৃণিত কালো আইন নামে পরিচিতি পেয়েছে দায়মক্তি (ইনডেমনিটি) অধ্যাদেশ। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথে জগদ্দল পাথরের মতো বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল এটি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যায় জড়িতদের বিচার থেকে রেহাই দিতে এ অধ্যাদেশ প্রণয়ন করা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তখনকার রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ জারি করেছিল দায়মুক্তি অধ্যাদেশ। এটি একটি বিরল ঘটনা। কারণ পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও এমন কোনো আইন ছিল না। এখনো নেই।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন, ভারতের মহাত্মা গান্ধী, ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্ধিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী, শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট বন্দর নায়েকসহ অনেক নেতা হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। কিন্তু সেসব হত্যার বিচার বন্ধে কোনো অধ্যাদেশ জারি করা হয়নি।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরিবারের অধিকাংশ সদসসহ নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর সংবিধান লঙ্ঘন করে স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি হন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। সংবিধানের ৫৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে, রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে তদস্থলে উপ-রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রপতিরূপে কাজ করবেন।

একইভাবে রাষ্ট্রপতি ও উপ-রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে স্পিকার রাষ্ট্রপতিরূপে কাজ করবেন। সংবিধানের এই বিধান বলবৎ থাকা সত্ত্বেও উপ-রাষ্ট্রপতি এবং স্পিকার দুজনকেই বাদ দিয়ে ক্ষমতা দখল করেন বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাত্র এক মাস দশদিন পর ২৬ সেপ্টেম্বর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন অবৈধ রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক।

দায়মুক্তি অধ্যাদেশ ছিল সম্পূর্ণ বেআইনি। রাষ্ট্রপতি অবৈধ হলে তার প্রণয়ন করা আইন কখনো বৈধ হতে পারে না। কিন্তু প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানও আইনটি বহাল রেখেছিলেন। এরপর ১৯৯৬ সালের ১২ জুন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে।

বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া শুরু করতে আইনি বাধা দূর করতে ‘দায়মুক্তি অধ্যাদেশ রহিতকরণ বিল’ সংসদে তোলা হয়। একই বছরের ১২ নভেম্বর আইনটি সংসদে পাস হয়। ১৪ নভেম্বর রাষ্ট্রপতির সইয়ের পর এটি পরিপূর্ণভাবে আইনে পরিণত হয়। এভাবে মোশতাকের জারি করা দায়মুক্তি অধ্যাদেশটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। এর পরই শুরু হয় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার কাজ।

মুজিব হত্যার বিচার হবে না, আওয়ামী লীগ কোনোদিন ক্ষমতায় আসবে না, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে না বলে যারা ভেবেছিলেন, তাদের সবকিছু ভুল প্রমাণ করে দিলেন শেখ হাসিনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *